স্বপ্ননীল
সালামালাইকুম ।
ওয়ালাইকুম সালাম ।
মায়াডারে লইয়া বড় বিপদে আছি স্যার । গেরাম থাইক্যা ভাইয়ের খোঁজে আইছিলাম । বাসা খোঁইজা পাই নাই । বাচ্চা মাইয়াডারে লইয়া সারাডা রাইত রাস্তায় বইসা আছিলাম । টেহা পয়সা যা আছিল সবি শেষ । বেলা দুপর অইয়া গেল পেটে দানাপানি কিচ্ছু পড়ে নাই । খিদায় মাইয়াডা কানতাছে ।
আমি ময়েটির দিকে তাকালাম । কাঁদছে বা একটু আগে কেঁদেছে মেয়েটিকে দেখে তেমন মনে হচ্ছে না । বেশ হাসি খুশিই মনে হচ্ছে তাকে । আমি বসে আছি বাসের সর্ব পেছনের ডান দিকের সিটে । ঢাকা থেকে ময়মনসিংহের গাড়ীতে ওঠে বসেছি । প্রায় তিন মাস পর বাড়ি যাচ্ছি । বাস থেমেছে জয়দেবপুর চৌরাস্তায় । বেলা প্রায় দুপুর হয়ে এল । তবে জহুরের আযান হতে এখনো প্রায় ঘন্টা খানিক বাকী আছে । আমার সিট বরাবর বাসের বাইরে লুঙ্গি ও পাঞ্জাবি পরিহিত অর্ধ বয়স্ক এক লোক দাড়িয়ে আছে । মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি । লোকটির পাশে দাড়িয়ে আছে বারো তের বছরের এক মেয়ে । মেয়েটি একবারও আমার দিকে তাকাচ্ছে না । দশ টাকার একখানা নোট আমি লোকটির হাতে দিলাম । নোটটি পকেটে ভরতে ভরতে লোকটি সামনের দিকে অগ্রসর হচ্ছে । আমি তাকিয়ে তাকিয়ে ওদের চলে যাওয়া দেখছি । আশ্চার্য ব্যাপার মেয়েটি একবারের জন্যেও আমার দিকে তাকায় নি !কেন তাকায় নি ঠিক বুঝতে পারছি না । সে কি অন্য কোনো ধ্যানে ছিল ? না, এতটুকু একটি মেয়ে আবার কিসের ধ্যান খেয়ালে থাকবে ?ধ্যাত ছাই । কী যে সব আবোল তাবোল ভাবছি ! ছোট্ট একটা মেয়ে । বিপদে পড়ে বাবার সাথে ঘুরে ঘুরে ভিক্ষে করছে । আমার দিকে তাকাল বা নাই তাকাল, তাতে আমার কী ? আমি ফের ওদের দিকে তাকালাম । মেয়েটি তার বাবার বাঁ হাত ধরে হাটছে । আমার থেকে ওদের দূরত্ব কতটুকু হবে ? এই সাত আট গজ । আমাকে অবাক করে দিয়ে মেয়েটি পেছন ফিরে তাকাল । আমার চোখে ওর চোখ পড়তেই আমি ভীষণ ভিমড়ি খেলাম । শিউরে ওঠল আমার সর্বাঙ্গ । আমাদের মাঝে প্রায় আট দশ গজের দূরত্ব হলেও মেয়েটি যখন আমার দিকে তাকাল মনে হল যেন অতি নিকটে অর্থাত্ সে আমার একেবারে সামনে দাড়িয়ে আছে । ভীষণ তৃ়ষ্ণার্ত ও ঝলমলে দুইটি চোখ । এত স্বচ্ছ চোখ আগে কখনো দেখেছি বলে মনে পড়ছে না । এই বয়সী মেয়েদের চোখ এ রকম হয় না । এই চোখ যেন আমার অনেক চেনা । যেন বহু অব্যক্ত কথা জমে আছে ঐ চোখে । কিছু একটা মনে করিয়ে দিতে চাচ্ছে সে আমাকে । কিন্তু সেটা কী ? ফের ওদের দিকে চোখ তুলে তাকাতেই আমি আরও বড় ধরনের ধাক্কা খেলাম । ওদেরকে আর দেখতে পাচ্ছি না । আমি ব্যাকুল হয়ে এদিক ওদিক তাকাতে শুরু করলাম । বাসের জানালা দিয়ে মাথা বের করে দূর দূর পর্যন্ত দৃষ্টি ফেললাম, তাতেও কোনো লাভ হল না । এত তাড়াতাড়ি কোথায় চলে গেল ? আশে পাশে কোনো ভিড় বাট্টাও নেই যে তাতে মিশে গেছে । এত তাড়াতাড়ি দৃষ্টির আড়ালে যাওয়া সম্ভব নয় । আমার শরীর ঘামে ভিজে যাচ্ছে । ভেতরে ভেতরে দারুন অস্থির লাগছে । মানিব্যাগ খুলে টাকা গুনে দেখলাম । না টাকাও ঠিক আছে । মানিব্যাগের এক জায়গায় রেখে ছিলাম বারোশত টাকা, আরেক জায়গায় তিনশত বত্রিশ টাকা । বেতনের টাকাটা রেখেছি পেন্টের ভেতরের পকেটে । সবই ঠিক আছে । ঐ লোকটিকে যে দশ টাকার একখানা নোট দিলাম সেটা তো কম হবার কথা । কিন্তু টাকা তো ঠিকই আছে । তাহলে লোকটিকে আমি কোনো টাকা দেই নি ? আমার স্পষ্ট মনে আছে, একটু আগেই বঙ্গবন্ধুর ছবিওয়ালা দশ টাকার একখানা নোট লোকটির হাতে দিয়েছি । কী সর্বনাশ ! আমি কি পাগল হয়ে যাচ্ছি !
( উপন্যাস, “স্বপ্ননীল, মিনু” থেকে)