মুক্তি যুদ্ধের গল্প (চতুর্দশ পর্ব )
পাথর ঘাটা অবস্থান কালে আমাদের দিন কাল ভালই যাচ্ছিল । আমরা ধৃত তিন জন পাক সেনাদের সখিপুর হেডকোয়াটারে পাঠিয়ে দিলাম । মাঠ ঘাটের পানি শুকিয়ে গেছে । ততদিনে যুদ্ধের গতিও ত্বরান্বিত হতে থাকলো । বিভিন্ন জায়গায় যুদ্ধে মার খেয়ে খেয়ে পাক সেনারা জেলা শহরের দিকে ক্লোজ হতে থাকলো । তাতে বুঝা যাচ্ছিল তারা আর বেশী দিন টিকে থাকতে পারবে না ।এভাবে চলতে চলতেই ডিসেম্বর মাস এসে গেল । ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহেই ময়মনসিংহ আক্রমন করে মুক্তি যুদ্ধারা দখল করে নিল । ময়মনসিংহ শহরে যে সকল পাক সেনা তারা মযমনসিংহ শহর থেকে মধুপুর হয়ে টাংগাইলের দিকে রওয়ানা হলো । মুক্তি যোদ্ধারা সংবাদ পেয়ে মাঝ পথে বাঁধা দিল । ফলে রাস্তায় রাস্তায় আক্রান্ত হয়ে পাক সেনারা প্রধান সড়ক ছেড়ে দিয়ে গ্রামে নেমে পায়ে হেটে ঢাকার দিকে রওয়ানা হলো ।মাঝে মাঝে গ্রামের মানুষেরা তাদের দাও লাঠি নিয়ে আক্রসন করে হত্যা করতে লাগলো ।
এমনই এক দিনে সেদিন ডিসেম্বর মাসের ৭/৮ তারিখ হতে পারে । সংবাদ এলো যে, একদল পাক-সেনা বাশতলৈ গ্রামের মাঝ দিয়ে পায়ে হেটে ঢাকার দিকে রওয়ানা দিয়েছে । আমরা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তৈরী হয়ে রওয়ানা হলাম । আমরা যত তাড়াতাড়ি যাই পাক-সেনারা আরও তাড়াতাড়ি হাটে । ঘন্টাখানেকের মধ্যে আমরা তাদেরকে পিছনে ফেলে আগে গিয়ে এক রাস্তার দুই পাশে এ্যাম্বোশ করলাম । কিন্তু বিধি বাম । আমাদের এ্যাম্বোশের কাছে পৌঁছার আগেই পাক সেনারা অন্য পথ ধরলো । আমরা আবার দৌড়াতে থাকলাম । বিপদ হলো এই যে, পাক সেনারা যায় রাস্তা ধরে আর অমরা দৌঁড়াই রাস্তাহীন মাঠ ঘাট জঙ্গল দিয়ে ।ফলে তাদের চেয়ে আমাদের পরিশ্রম বেশী হচ্ছিল । যতটা সম্ভব দ্রুত গতিতে দৌঁড়ে তাদের পিছনে ফেলে পজিশন নিলাম । তখন দেখি আমার পাশে আমাদের এলাকার এক হিজড়া ছিল , সে বসে আছে । স্বাস্থ্যের দিক থেকে সে ছিল অনুমান ৫ফুট ১০ ইঞ্চি লম্বা , কালো দ্বৈত্যের মতো । আমি অনেক বুঝাতে চেষ্টা করলাম চলে যেতে । আমি তাকে বললাম, আমরাতো মরণ স্বীকার করেই যুদ্ধে এসেছি । কিন্তু তুমিতো যুদ্ধে আসনি । এখানে থাকলে গুলি লেগে মারা যেতে পার । কিন্তু সে আমার কোন কথাই শুনলো না । আমার পাশেই বসে রইল । আমরা যেখানে বসেছিলাম সেটা ছিল একটি ঘুনি । রুপা আমন ধানের ক্ষেত । ধান কেটে নিয়েছে । কিন্তু ক্ষেতে ধানের গুড়ার অংশ আছে । ক্ষেতের পানি শুকিয়ে গেলেও কাঁদা শুকায়নি । আমার মনে হচ্ছে ঘুনি শব্দটা তোমরা বুঝতে পারছ না । আমাদের এলাকার ভূপ্রকৃতি সম্পর্কে ধারনা ণা থাকলে বুঝা কষ্টই হবে । আমাদের এলাকায় দুই ধরনের জমি । এক ধরনের হলো উচু মাল ভূমি , লাল মাটির ।সে সব জমির অধিকাংশ এলাকাই বনাঞ্চল ।মাঝে মাঝে পরিস্কার করে জন বসতি গড়ে উঠেছে । এই সকল উচু ভূমির মাঝ খান দিয়ে আছে নিচু ভূমি । আমার মনে হয় হাজার হাজার বছর আগে এই সকলউচু ভূমি গুলো টিলা ছিল । যুগ যুগ ধরে বৃষ্টির পানি টিলার মাটি ধুয়ে নামীয়ে টিলাকে অনেকটা সমতল করেছে । আর দুই টিলার বৃষ্টির পানি যেখান দিয়ে নামতো পানির স্রোত টিলার উপরকার মাটি ধুয়ে নিয়ে ভাটির দিকে চলে যেত । কাল ক্রমে মাটি পরতে পরতে নালা গুলি ভরাট হতে থাকে ।
ভাওয়াল মধুপুর মালভূমির গঠন প্রকৃতিই একটু অন্য রকম । বর্তমানে এ এলাকায় দুই ধরনের ভূমি আছে । উচু ভূমি এবং উচু ভূমির মাঝখান দিয়ে ক্রমান্বয়ে ঢালু নিচু ভূমি । জড়িপের কাগজ পত্রে উক্ত জমিকে চালা ও নালা বলে নাম দেওয়া হয়েছে । আমাদের এলাকায় উচু ভূমিকে চালা এবং নিচু ভূমিকে বাঈদ বলে ।আবার বাঈদ থেকে যে সকল শাখা ক্রমান্বয়ে উচু হয়ে উঠে গেছে সেগুলিকেই বলে ঘুনি । বৃষ্টির পানিতে টিলার মাটি ধুয়ে টিলা নিচু হওয়ার সাথে সাথে টিলা বিধৌত মাটি পড়ে নদী গুলি ভরাট হতে থাকে ।ছোট নদী এ খাল গুলো ভরাট হয় মানুষের হাতের ছোয়া পেয়ে । তিন/ চার শত বছর বা তারও আগে মানুষ যখন এ এলাকায় বসবাস শুরু করে তখন দুই টিলার মাঝের বয়ে যাওয়া নালার দুই পাশ থেকে মাটি কেটে নালার খাদে ফেলে দেয় । ফলে নালার খাদ ভরাট হয়ে গভীরতা কমে কিন্তু প্রসস্থতা বাড়ে এবং ঘুনি নাম ধারণ আবাদী জমিতে পরিনত হয় । আদি কালের মানুষেরা এই সকল নালার মাঝে মাঝে বাঁধ দিয়ে বর্ষার পানি আটকিয়ে রোপা আমন ধানের চাষ করতে শুরু করে । একই উপায়ে মাটি ধৌত হয়ে নদীতে পড়ে এবং ছোট ছোট নদী গুলো
ভরাট হয়ে বাঈদ নামে রোপা আমন ধানের জমিতে পরিনত হয় ।
আমরা যেখানে পজিশন নিয়েছি সেটি একটি ঘুনি । এর একপ্রান্ত গিয়ে দক্ষিণ দিকের রাস্তায় মিলেছে, যে রাস্তা দিয়ে পাক সেনারা রওয়ানা হয়েছে । অপর প্রান্ত ভাটির দিকে গিয়ে বাঈদ জমিতে মিশেছে । আমি যার পর নেই উত্তেজনা নিয়ে বসেবসে আছি যে, ঘুনির মাথার রাস্তায় পাক সেনা দেখা দিলেই গুরি করতে শুরু করবো । এমন সময় আমার পাশে থাকা হিজড়া লোকটি দুই হাটুর উপর ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে চিৎ কার দিল “ওই যে বিহাড়ী যায় “ । এই চিঁৎ কার সাথে সাথেই পাক সেনাদের কানে পৌঁছলো এবং তারা আমাদের দিকে তাকিয়েই গুলি চালালো ।সাথে সাথেই হিজড়া লোকটি উপুর হয়ে মাটিতে পরে গেল । যার নাম এখন আর আমার মনে নেই । আমি একটি গাছের আর নিয়ে গুলি ছুড়তে থাকলাম । কিন্তু দেখতে পেলাম পাক সেনারা হেটে হেটে চলে গেল । আমার একটি গুলিতে একজন পাক সেনা পড়ে যেতে দেখেছিলাম ,পরে গিয়ে দেখলাম উক্ত স্থানে রক্ত পরে আছে । বুঝলাম সেনাটি আহত হয়েছিল । পরে উঠে চলে গেছে । আমাদের সাথে থাকা একজন লোক মারা যাওয়ার কারণে আমরা আর উক্ত ভেগে যাওয়া পাক সেনাদের পিছু ধাওয়া করলাম না ।মৃত লোকটিকে গ্রামের মানুষদের নিকট দাফন করার জন্য বুঝিয়ে দিয়ে আমরা পাথর ঘাটা ক্যাম্পে ফিরে এলাম । সাথে থাকা একজন লোক মারা যাওয়াতে মনটা খুব খারাপ যাচ্ছিল । পরদিন সারাক্ষণ ঐ লোকটির কথাই মনে হতে থাকলো । বার বার মনে হতে থাকলো , কেন আমি শক্ত করে নিষেধ করলাম না । তা হলে হয়তো সে চলে যেত ।অবশ্য এমনও হতে পারতো যে, সে না থাকলে পাক সেনারা আমাকেই টার্গেট করে গুলি ছুড়তো । দেখতে তাকে আমার চেয়ে অনেক বড় সড় দেখা যাওয়াতেই আমাকে গুলি না করে তাকে গুলি করেছে ।
আমার সাথে থাকা একজন মানুষের মৃত্যু নিয়ে ভাবতে ভাবতেই একদিন কেটে গেল ।পরদিন ভোরে সংবাদ এলো পৌলি গ্রামের এক বাড়িতে পাক সেনারা রাতে এসে অবস্থান নিয়েছে ।এই সংবাদ পেয়ে আমরা সেই গ্রামে চলে গেলাম । আমরা বুঝতে পারলাম এরাও ময়মনসিংহ সেনানিবাসের সৈন্য । ময়মনসিংহ মুক্তি যোদ্ধারা দখল করে নেওয়ায় পালিয়েছে । সম্ভবত সেদিন ছিল ডিসেম্বরের ১০ তারিখ । আমরা ঘটনা স্থলে পৌঁছে দেখলাম যে বাড়িতে পাক সেনারা অবস্থান নিয়েছে সেবাড়িটি আমাদের অবস্থান থেকে অন্তত ১৫/১৬ ফুট উচু । অর্থা সেই এলাকা বর্ষা কালে ১৫/১৬ ফুট পানির নিচে ডুবে য়ায় । পাক সেনারা বাড়ির উপর আর আমরা বাড়ির নিচে মাঠের মধ্যে । মাঠের মাঝে সামান্য উচু উচু আইল আছে, আমরা তার আড়ালে পজিশন নিলাম ।কাঝেই ১৫ ফুট বাড়ির উঠুনের মাঝ খানেকেহ দাঁড়িয়ে থাকলেও ১৫ ফুট নিচু মাঠ থেকে গুলি ছুড়লে বাড়িতে থাকা কোন লোকের গায়েই গুলি লাগবে না । সকল গুলি বাড়ির কিনারে মাটিতে গেঁথে যাবে ।সে কথাা এত বছর পরে বুঝতে পারি, কিন্তু তখন বুঝতাম না ।ফলে ঘটনা স্থলে পৌঁছেই বাড়ির উত্তর দিকের মাঠের মাঝে মাঝে পজিশন নিয়ে গুলি ছুড়তে থাকলাম । সকাল ১০ টার দিক থেকে যুদ্ধ শুরু হলো , দুইটা পর্যন্ত গুলি ছুড়া চলতে থাকলো । তার পর আর পাক সেনারা গুলি চুড়ছিল না । তখন মুক্তি যোদ্ধারা মনে করলো পাক সেনাদের নিকট হয়তো গুলি নেই । তাদেরকে আত্মসমর্পণ করার জন্য অনেক ডাকাডাকি করা হলো । কিন্তু তারা কোন জবাবো দিচ্ছিল না । ফলে তাদের কাছে কোন গুলি নেই মনে করে মুক্তি যোদ্ধারা দৌঁড়ে বাড়িতে উঠার চেষ্টা করতেই পাক সেনারা একটি ব্রাস ফায়ার করলো । সাথে সাথে আমাদের আগে আগে মুক্তি যোদ্ধা ছিল সে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো ।আমরা কোন রকম মাটিতে শুয়ে পরে গড়িয়ে, বুকে হেটে আবার মাঠের মাঝে এসে পজিশন নিয়ে গুলি ছুড়তে থাকলাম । আমরা যে স্থানে পজিশন নিয়েছিলাম সে স্থান থেকে আহত মুক্তি যোদ্ধাকে দেখাা যাচ্ছিলো ।সে মাঝে মাঝে সাহায়্যের আশায় মাথা তুলে আমাদের দিকে তাকাচ্ছিলো ।কিন্তু আমরা আগাতে গেলেই পাক সেনারা গুলি ছুড়ছিলো । ফলে তাকে কোন ভাবেই আনা গেল না ।তাকে মাথা তুলে তাকাতে দেখে সবাই কান্নায় ভঙ্গে পড়ছিল ।কিন্তু এগোতে গেলেই পাক সেনারা গুলি করার কারনে আমাদের কমান্ডার আহতকে আনতে কাউকে যেতে দিলেন না ।বিকালের দিকে দেখা গেল উত্তর দিকের আকাশ থেকে ঝাকে ঝাকে বিমান আসছে এবং বিভিন্ন স্থানে বোমা ফেলছে ।তাথে সহজেই বুঝা যাচ্ছিল যে, ঐ গুলি ভারতীয় বিমান । অর্থা আমাদের দেশ স্বাধীন হয়ে যাচ্ছে বলে । সবাই আনন্দে লাফিয়ে উঠলো । আর সেই সময় আমাদের চোখের সামনে মরে যাচ্ছে একজন মুক্তি যোদ্ধা ্ আমরা কিছুই করতে পারছি না । এর চেয়ে কষ্টের মূহূর্ত আর আছে কিনা আমার জানা নেই ।বেলা ডুবে অন্ধকার হয়ে গেলে আমাদের দুই জন মুক্তি যোদ্ধা ক্লোরিং করে গিয়ে আহত মুক্তি যোদ্ধাকে নিয়ে এলো । আমাদের কাছে নিয়ে এলে দেখা গেল তার দুই পায়ের রানে ব্রাস ফায়ার লেগে পা দুটোই ভেঙ্গে গেছে ।অন্য কোথাও গুলি লাগেনি। কিন্তু দীর্ঘ সময় রক্তক্ষরণের ফলে সে মারা গিয়েছে ।রাতের আঁধারেই পাক সেনারা পালিয়ে গেল ।আমরা ক্যাম্পে ফিরে এলাম ।ক্যাম্পে ফিরে এলাম বটে কিন্তু কিছুতেই স্বস্তি পাচ্ছিলাম না ।আমাদের সাথে যে ছেলে দীর্ঘ নয় মাস যুদ্ধ করলো শেষ দিনে এসে তাকে বিদায় দিয়ে এলাম ।সারা দিন আমাদের মাথার উপর দিয়ে আমাদের মাথার উপর দিয়ে ভারতীয় বিমান ঝাকে ঝাকে উড়ে গিয়ে সামনের দিকে বোমা ফেলতে লাগলো ।খুশীতে পাগল হওয়ার মতো অবস্থা হলেও আমরা আনন্দ উপভোগ করতে পারছিলাম না ।বিপদের সময়কার বন্ধুত্ব ঘনিষ্ঠতা হয় বেশী ।তাই আমাদের মৃত বন্ধুর কথা কিছুতেই ভুলতে পারছিলাম না । পর দিন সংবাদ এলো টাঙ্গাইল শহর মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে চলে এসেছে । আমরা সবাই যেন স্বাধীনতার গন্ধ পেয়ে আনন্দে ভাসছিলাম ।