চুপকথা
বৃষ্টিস্নাত সকাল। বাসে সফর করছে অনি। পুরা নাম অনিরুদ্ধ হাওলাদার। সংসারে অনিকে সাদরে বরণ করে রুদ্ধকে যখন অনাদরের আবর্জনায় নিক্ষেপ করা হয় তখন পূর্ণরূপে রূপায়িত হয় ‘অনি’। বর্তমানে তাকে ‘অনিরুদ্ধ’ বললে বান্ধবমহলেও চেনা দায়। চালকের পিছনাসনে আসীন। রঙিন চশমা পরে আছে চোখে। না না–একেবারে রঙিন বলা সমীচীন হবে না, কালোর উপর ঘোলাটে ধূসর। বাইর থেকে চোখদুটো দেখার কোনো সুযোগ নেই। স্টপ স্টপে যাত্রী উঠানামা চলছে। শ্রাবণের মাঝামাঝি সময়। এ সময়টাতে বৃষ্টির উপর আস্থা রাখা যায় না, যখন তখন বর্ষণমুখর হয়ে উঠতে পারে–কখনো প্রবলাকারে মুষলধারে, কখনোবা মৃদু মৃদু থেমে থেমে। বর্তমানে আকাশের রঙ ফর্সা, তবু গুটিগুটি বৃষ্টিফোঁটা ঝরছে অজস্র। সাদা এপ্রন পরা একটি মেয়ে উঠে বসল চালকাসন ঘেঁষে অনির হাঁটুদুটো স্পর্শ করে একেবারে তার সম্মুখে। বৃষ্টিভেজা তরুণীর অবয়বে ফুটে উঠেছে অপ্সরারূপ! আপ্লুত চুলের গুচ্ছ বেয়ে ‘টপ’ ‘টপ’ করে ঝরে পড়ছে স্বচ্ছ জলের ফোঁটা। ললনার এক হাতে কিছু বইখাতা অন্য হাতে একটা পরিষ্কার চশমা ও সামান্য একটা লেখনী। সহজে বুঝা যাচ্ছে কোনেক কলেজছাত্রী, রওনা হয়েছে বিদ্যালয়োদ্দেশ্যে। পাশে বসা যাত্রিণীর সঙ্গে টুকটাক আলাপে জানা গেছে, ছাতা একটা সঙ্গে ছিল কিন্তু কলমটা ক্রয়কালীন যথাস্থান থেকে দোকানিকেও ফাঁকি দিয়ে উধাও!
গাড়ির হেলনেদোলনে টালমাটাল যাত্রীসকল। চালকের ব্র্যাক কষাকষিতে সুদর্শনার হাঁটুদুটো অনির হাঁটুদুটোকে বারবার স্পর্শ করছে। কচুলতা খেলে যেমন করে চুলকে উঠে গলা তেমনভাবে সুড়সুড়ি হচ্ছে অনির হাঁটুদুটোতে। তবে কচুলতার চুলকানিকে অম্ল খেয়ে দমন করা যায়, দেহের চুলকানিকে ওষুধ দিয়ে কিন্তু মনের চুলকানি? এ চুলকানি ত আর অম্ল খেয়ে বা ওষুধ মালিশে সাড়ার নয়। এমন মুহূর্তে মনের অনুভূতি কী রকম হতে পারে পাঠকগণ ছাড়া লেখকের বুঝার সাধ্যাতীত। মাঝে মাঝে কেবল আড়চোখে চক্ষুবিনিময় হচ্ছে দুয়ের। একে অপরের দিকে মুগ্ধচোখে তাকাচ্ছে বারবার। অনির পাশের সিটে বসা একজন পঞ্চাশোর্ধ্ব বয়স্ক, ভদ্রলোক জানালার ফাঁক দিয়ে বারবার বাইরে চাচ্ছে। এসব তাঁর দেখা হচ্ছে কিনা বুঝা যাচ্ছে না। এমন সময় চালকের এক অকল্পনীয় কাণ্ডকে অনেকে মন্দ বললেও অনির জন্য শুভক্ষণ, একেবারে প্রভুর দয়া বলতে হয়! ঘটেছে কী? কৌতূহলী অনেকে–নিরীহ এক কুকুরকে বাঁচাতে চালক গাড়িগতিরোধ করলে প্রচণ্ড ধাক্কা লাগে অসতর্ক যাত্রীগণে। সেমুহূর্তে অনি মেয়েটির বুকে মাথাঘাত করলে লজ্জায় লজ্জিত দুজন ‘দুঃখিত’ ‘দুঃখিত’ বলে অনি দুঃখপ্রকাশ করলে শরমে আনতমুখে মেয়েটি ঈষৎ হাসে–বলে, ঠিক আছে…ও কিছু না। তারপর কিছুদূর এলে একটা স্টপে সুদর্শনা গাড়ি থেকে নেমে পায়ে হেঁটে গন্তব্যোদ্দেশ্যে চলে যেতে দেখা যায়। যেতে-না-যেতে ফিরে ফিরে বারবার পিছনে তাকাচ্ছে। অনিও চোখের চশমাটা মাথায় তুলে যতদূর মনোরমাকে দেখা যাচ্ছে জানালার ফাঁক দিয়ে পরিচিতার ন্যায় অপলকে চেয়ে আছে। অনি যাচ্ছে শহর থেকে বাড়ি কিন্তু দিশেহারা মন তার এমুহূর্তে হারিয়ে গেছে কল্পনার ঝিলমিল রঙের জগতে…
আজকাল কোনো কাজেই মন বসছে না অনির, মনটা কেবল ধায় ধায় করছে। এমনকি খাওয়াদাওয়াতে পর্যন্ত কোনো রুচি নেই। ডিউটিতে বল-কি-ছুটিতে যেখানে যাচ্ছে উদাসীনতা পিছু ছাড়ছে না। সহকর্মী বন্ধুদের কেউ জিজ্ঞেস করলে ম্লান হেসে বলছে, দুর, কিছু-না। আগে ছুটিতে বাড়ি আসলে সারা দিনের মধ্যে এক ঘণ্টা ঘরে টিকা দায়। গ্রামের বাল্যবন্ধুদের সঙ্গে গল্পগুজব আর দাবা তাস ক্রেরামের আড্ডায় কেটে যাচ্ছে দিন। মা ছেলের সঙ্গে একটু সুখদুঃখের কথা বলবে তাও কোনো বারে সহজ হয়ে উঠে না। বর্তমানে বলতে গেলে এক ধাক্কায় সবকিছু ওলটপালট হয়ে গেছে! একজন মন্দ মানুষ যদি এভাবে পরিবর্তন হয়ে যেতে পারত। বরং পারবে না বলেও কোনো কথা নেই। এখানে আমরা সবকিছু ভাগ্যলিপির উপর ছেড়ে দেওয়ার পক্ষপাতি নই। এখানে আমরা মনের উপর সমস্ত কিছুর জোর দিব। একজন মানুষ যদি চায় রাতারাতি আউলিয়া হতে পারে, নিজের মনকে পলকে বাদশাহি তখ্তে বসাতে পারে; আবার চাইলে বেশ্যাতেও রূপান্তরিত করতে পারে। সব মানুষের মনের খেয়াল এবং মানুষের মনের ইচ্ছা। অনির পরিবর্তন অনেককে অবাক করে। ইদানীং বাড়ি এলে দরজাটা বন্ধ করে সারা দিন নিজের রুমে বন্দি–কী করে বুঝে আসে না কারও। আগে যেছেলে মাসে-দু-মাসে একবার বাড়ি আসা দূরে থাক, চার-ছয় মাসও অনেক সময় পার হয়ে যাচ্ছে খবর নেই; সেখানে আজকাল সাপ্তাহিক যাতায়াত করতে লাগল! এমন পরিবর্তন শুধু বন্ধুদেরকে নয় শত্রুকেও আশ্চর্য করে। যেখানে যাচ্ছে অপরিচিতার ছবি ছাড়া অন্য কিছু কল্পনায় আসছে না। ভাবনায় কেবলই তার হাস্যোজ্জ্বল সুবর্ণ মুখটা ভেসে ভেসে উঠছে বারবার। এবার আমরা সহজেই বুঝে নিতে পারি এমন কারও মনের অবস্থার কথা?
অনি সদ্য বিএ পাশ করা একজন কর্মিষ্ঠ যুবক। শহরের বিখ্যাত একটি পোশাক-রপ্তানি-কোম্পানির উচ্চপদস্থ কেরানি। মাসিক বেতন চৌদ্দ হাজার। সংসারে মা আর ছোট্ট একটি বোন। শহর থেকে গ্রামের দূরত্বটা একান্ন-কি-বাহান্ন মাইল। ইতোমধ্যে কয়েকবার বাড়িতে আসাযাওয়া হয়ে গেছে, মেয়েটির সাক্ষাৎ মিলে না। এখানে অনি কেন, কথাটা এভাবে যেকেউ মনে করা যৌক্তিক, পথের দেখা কে কবে মনে রাখে–হয়তো মেয়েটি ওখানেই ভুলে গেল সব। কিন্তু না, ঘটে তার বিপরীত। আরেকদিন বর্ষামৌসুমটা যায় যায়, কাঠফাটা রোদ বের হয়েছে আকাশ ফেটে; অনি যাচ্ছে বাড়ি, মেয়েটি উঠল গাড়িতে। নারী-আসন থেকে পুরুষাসন পর্যন্ত কোথাও একখণ্ড জায়গা অবশিষ্ট নেই যে, দুদণ্ড স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে দাঁড়ায়। অনি মনে করল, এরকম অতিরিক্ত মানুষের ভিড়ে ঠেলাঠেলি করে একজন যাত্রিণী আসন ছাড়া দাঁড়িয়ে থাকবে, এটা যেকোনো সভ্য দেশের জন্য অসভ্যব্যাপার এবং জঘন্য বিষয়ও বটে। এমন অসৌষ্ঠব অশিষ্টতাকে যারা আস্বাদ মনে করে তারা বর্বর–মনুষ্যনামের কলঙ্ক। আর নারীকে যারা শ্রদ্ধা করে না তারা পুরুষনামেরও কলঙ্ক। একটুপর অনির চোখাচোখি হয় মেয়েটির–মনকাড়া হাসি হেসে বলল, আপনি!
অনি কবে হতে আসন ছেড়ে দাঁড়িয়ে আছে…এবং মৃদু হেসে তার আসনে বসার আমন্ত্রণ জানায়। মেয়েটি মুচকি হেসে আপত্তিকণ্ঠে ধন্যবাদ জানায় এবং চোখের ইশারায় বুঝায়, যথাস্থানে ঠিক আছে। কিন্তু অনির বিনয়ী আবেদনে সাড়া না দিয়ে পারল না…
অনি দাঁড়িয়ে আছে মেয়েটির পাশে। সত্তর কিলোমিটার বেগে ছুটে চলছে গাড়িটি। চালকের ব্র্যাক কষাকষিতে হেলেদোলে বারবার স্থির হচ্ছে দাঁড়ানো যাত্রীরা। মেয়েটি আড়চোখে বারবার অনির দিকে তাকাচ্ছে…অনিও বারবার…পরস্পর পরস্পরকে সঙ্কোচ করছে। লজ্জায় একে অপরকে কিছুই বলতে পারছে না। আড়াআড়িভাবে দুজন দুজনাকে আকৃষ্ট চোখে চাচ্ছে। উভয়ের চোখেমুখে অনুরাগের লজ্জাভাব। চালক সজোরে ব্র্যাক কষল–টালমাটাল যাত্রীগণ পড়ার উপক্রম। মেয়েটি অনির হাত ধরে টেনে স্থির করল। অনি হেসে বলল, ধন্যবাদ…
লজ্জালাল মেয়েটি মাথা নিচু করে একটু হাসল এবং উত্তরে কিছুই বলল না। হঠাৎ বজ্রসঙ্কেত–প্রলয়ান্ধকার হয়ে তুফানবেগে ছুটছে বাতাস। গাছপালা ভেঙে চুরমার করে সম্ভবত এক্ষুনি মাটিতে পাতবে আসন। যাত্রীরা চালককে বারবার সতর্কবার্তা শুনাচ্ছে–গাড়ির গতিশক্তি যাতে কমায়, প্রয়োজনে রোধ করে; আকাশের পরিণতি কি বুঝা যাচ্ছে না। তারপর ক্রমান্বয়ে বাতাসের গতি হ্রাস পেল। মেয়েটির গন্তব্য এল। আসমানে এখনো ভাসছে কালো মেঘের ভেলা–একটু পরপর বজ্রগর্জন। অনিকে নেমে আসার আভাস দিয়ে মেয়েটি হুড়মুড় করে গাড়ি থেকে নেমে পড়ল। অনির হৃদয়কাঁপন শত বেগে বেড়ে চলল! মিরের হাট যাত্রীছাউনি থেকে আধা মাইল পশ্চিমে মেয়েটির বিদ্যালয়। নিয়মিত পায়ে হেঁটে গমনাগমন করতে হয় এটুকু পথ। রাস্তাটা প্রায়ই নির্জন, পথিকের চলাচল তেমন একটা চোখে পড়ে না। কারণ এখানকার শিক্ষার্থীদের জন্যে এ রাস্তার উৎপত্তি এবং বিদ্যালয়মাঠ পর্যন্ত এসেই যাত্রাশেষ। এ সংকীর্ণ পথটা মেয়েটির জন্য সংক্ষিপ্ত কিন্তু নিরাপদ নয়।
দুজন পাশাপাশি হাঁটছে, আলাপাদি টুকটাক চলছে, তবে কী কথোপকথন হচ্ছে তা শুনা যাচ্ছে না। কাঠের কৃত্রিম পায়ে ভর দিয়ে একজন পঙ্গুভিক্ষুক পাশ কেটে চলে যেতেই অনি ভিক্ষুকের হাতে পাঁচটি টাকা গুজে দিল–ভিখারি যেন পৃথিবী পেল। এমন সময় ঝুমঝুমিয়ে বৃষ্টি এল। সামনে দেখা যাচ্ছে জীর্ণ বেড়ার পরিত্যক্ত একটা টিনের চৌচালা ঘর। বুঝা যাচ্ছে দোকানঘর। সম্ভবত কোনেকসময় চা-রুটির দোকান ছিল। অনি আর মেয়েটি দৌড়ে এসে দোকানটাতে আশ্রয় নিল–মনে হল সাপের ঘাঁটি। কত বছর ধরে ব্যবহার-অযোগ্য হয়ে পড়ে আছে বুঝার উপায় নেই। বায়ুকোণে মস্ত একটা বটগাছ। দোকানটা হেলে গিয়ে গাছটার গায়ে ঠেস দিয়ে কবে হতে দাঁড়িয়ে আছে কে জানে। এ গাছই আজ দোকানটার বড় সহায়ক। মাকড়সা বুনেছে যেখানে-সেখানে বাসা। উইপোকা গড়ে তুলেছে ঢিপি। ইঁদুর খোঁড়েছে অসংখ্য গর্ত। নৈঋর্তকোণে বড়ই শান্তিতে ঘুমাচ্ছে একটি কুকুর। ঈশানকোণে দুটো বাচ্চা নিয়ে লোটে আছে একটি ছাগি। বৃষ্টি হচ্ছে দেদারচে, এক-একটি ফোঁটা যেন তার এক-একটি পাটকেল। একটু পর শুনা গেল ভনভন শব্দ। দেখা যায়, ঘুণপোকায় আক্রান্তছাদের ভাঙা খুঁটিতে মস্ত একটা মৌচাকের। মৌচাকটা দেখে শুধু একজন মৌয়াল নয়, যেকোনো সাধারণ মানুষও খুশি হবে এবং আশ্চর্য অনুভব করবে। অনিও আশ্চর্য অনুভব করল–বলল, সম্ভবত এখনো কোনো মানুষের নজরে আসে নি।
মেয়েটি বলল, হয়তোবা। তবে যার ভাগ্যে আছে, এটা সুনির্দিষ্টভাবে লিখা থাকে কিন্তু : সে অবশ্য ভাগ্যবান–ভাগ্যিস…
মধুর প্রতি ললনার আগ্রহ দেখে অনিও আগ্রহী দেখাল–বলল, আপনার ভাল লাগে? আমার কিন্তু অত্যন্ত…
মেয়েটি চমৎকৃত হয়ে বলল, বা রে! লাগবে না মানে, মধু কার-না ভাল লাগে বলুন? এটা একটা মহৌষুধও বটে।
অনি রসিকতা করে বলল, তাই নাকি! অনেক কিছু জানেন দেখছি।
মেয়েটি বলল, অনেক কিছু জানি না, তবে মধুর কার্যকরটা কিছুটা জানি আরকি। এটাকে নিয়ে এখনো বোধহয় তেমন একটা রিসার্চ হচ্ছে না কোথাও, তবে অনেক গবেষণা হওয়া দরকার। কারণ মধুতে নাকি অনেক গুণ আছে, বিশেষ করে মানুষের উপকারিতা।
অনি হেসে বলল–এত দিন জানতেম মধুর প্রতি দুর্বলতা কেবল পুরুষেরই থাকে, আজ জেনেছি মেয়েদের দুর্বলতার কথা!
মেয়েটিও ঠাট্টার ছলে হাসল–বলল, দুর্বলতা! আকর্ষণ কেন নয়?
অনি হেসে হেসে বলল, যে জিনিসকে মানুষ মরিয়া হয়ে চায় সেই জিনিসের কাছে সে সব সময় দুর্বল। এবং আকর্ষণীয়তার বিপরীত দিক হচ্ছে দুর্বলতা।
মেয়েটি বলল, গুপ্তধনের প্রতি সকলের যেমন একটা টান–এও ত একপ্রকারের গুপ্তধন।
মেয়েটির কথায় অনি আবেগপ্রবণ–বলল, গুপ্তধনের সন্ধান যখন অনায়াসে মিলেছে তা হলে আর দেরি কেন…
মেয়েটি আশ্চর্যগলায় বলল–না না, আপনি একাজ করতে যাবেন না; একাজ খুব কঠিন, একজে কত কৌশলের দরকার আপনার জানা আছে?
অনি খুব হাসল–বলল, জানব না মানে, খুব জানা আছে–কঠিনকে সহজ করা অনির বাঁ হাতের খেলা।
তার দুষ্টামিভাব দেখে যথাসম্ভব মেয়েটি করুণাময়ী–অনুরোধ করে বলল, দোহাই…থাকতে দিন-না ওদেরকে আরামে। কারও ক্ষতি করে আনন্দলাভ করা অমানবিক। আমাদের একটু আনন্দে ওদের বিরাট ক্ষতি হতে পারে। সৃষ্টির সমস্ত কিছু মানুষের উপকারে আসে সুতরাং মানুষ কি কখনো তাদের উপকারে আসে?
ইতোমধ্যে দুজনের আলাপের মধ্যে নাম জানাজানির বিষয়কে ধারণ করে অন্যান্য কথোপকথনকে নগণ্য হিসাবে বাদ দিব–মেয়েটির ডাকনাম বর্ষা। ভাল নাম অর্পিতা দেবী। হিন্দুসমপ্রদায়ের ব্রাহ্মণতনয়া। ‘বর্ষা’ নাম শুনে অনি দ্বিধান্বিত ছিল না, কারণ সব গোত্রে বর্তমানে এ নামের সমাহার। কিন্তু ‘অনিরুদ্ধ’ নাম শুনে বর্ষা দ্বিধান্বিত ছিল, কারণ এ নাম এখনো বোধহয় একটা সীমানার গণ্ডি পার হয়ে বেরিয়ে আসতে পারে নি। অনি মুসলিম জেনে বর্ষা বাকরুদ্ধ!
যাই হোক, ভাল লাগার বিষয় যেখানে প্রেমের প্রধান্য সেখানে। অনেক কথা দুজনাতে চলল তারপর অনি হাসতে হাসতে বলল, তাই ত বলি–বর্ষারূপের এত সাতকাহন বর্ণনা কেন।
বর্ষা চমৎকৃত হল–বলল, কেন?
অনি বলল, আপনার নাম বলে যে কথা…
এ নিয়ে বর্ষাও খুব ঠাট্টাপরিহাস করল–বলল, পৃথিবীতে মনে করি–বর্ষা-বৃষ্টি নাম খুবই সস্তা, এ নাম এতটা অমূল্য নয়। তবে নির্দিষ্ট কারও নাম হলে যে ছেলেরা অত্যাকৃষ্ট হয় তা জানি! মেয়েরা কিন্তু ছেলেদের কোনো আখ্যোপাধি নিয়ে বিস্ময় বোধ করে না।
অনি ম্লান হেসে বলল, জানি, তবে–
বর্ষা কৌতুকের হাসি হেসে বলল, মেয়েদের গুণগান গাওয়া ছেলেদের নতুন কোনো বিষয় নয়, এটা ছেলেদের একান্ত স্বভাব–ছলচাতুরিও বলা যায় এবং নারীমুগ্ধতার কৌশলাবলম্বনও।
অনি আবারও ম্লান হাসল–বলল, কথাগুলো যদি আমার উদ্দেশ্যে বলা হয়, তবে বলব, আমি সত্যকে গলাটিপে হত্যা করে মিথ্যার আশ্রয়ে কখনো পথ চলি না এবং কারও সঙ্গে রসিকতা করতে পারি–প্রবঞ্চনা না। আমার আরও কিছু বিশ্রী স্বভাব আছে, আমি কাকে আঘাত করি ত ফুল দিয়ে–পাথর দিয়ে নয় এবং সাজা দিই ত শ্রীকান্তকারাগার–নির্জন কোনো অন্ধকার দ্বীপ নয়। আঁধার ঘরে আমার জন্ম হয়েছে ঠিক কিন্তু অন্ধকারে পথ চলতে আমি ভালবাসি না। আপনি কী মনে করছেন জানি না, তবে আমার কথাবার্তায় এমন কিছু যদি মনে করে থাকেন, তা হলে সেটা হবে আপনার নিতান্ত ভুল। কারণ, আমি কারও জীবন নিয়ে ঠাট্টা করতে পারি–জুয়া খেলতে পারি না। বাঁশবাগানের প্রত্যেকটি বাঁশ যেমন একই ধাঁচের হয় না তেমন বিধিসৃষ্টির সকল জিনিসও কিন্তু এক রকমের হয় না।
বর্ষা অনুতপ্ত হয়ে বলল, দুঃখ পেলেন বুঝি? আপনাকে দুঃখ দেওয়া ত আমার উদ্দেশ্য ছিল না। আসলে–মরণাবধি মানুষের শিক্ষার প্রয়োজন আছে। কথাটা নেহাত সত্য। উপহাসে মানুষ বিরক্ত হয় জানি কিন্তু উন্মত্ত হয় জানতাম না।
অনি বলল, কিছু কিছু মানুষের এরকম বদাভ্যাস থাকা ভাল–যা আমি মনে করি।
বর্ষা বলল, আপনার মনে করা আমার মোটেও মনে লাগে নি।
অনি বলল, নাইবা লাগল–কিন্তু ওজনহারা মানুষকে কখনো আমি সুজন মনে করি না।
বর্ষা বলল, এ কথাটা ভাল লাগল। তারপর দুজনের বেশ ঘনিষ্ঠতা গড়ে উঠল : একে অপরের প্রতি সীমাহীন মুগ্ধ–বেশ মিলামিশাও চলছে আজকাল। অপূর্ব প্রেমের স্রোতে ভেসে পাড়ি দিতে চায় দুজন মহাসমুদ্র।
বর্ষা মধ্যবিত্ত পরিবারের আদরের মেয়ে। দুই ভাই ও দুই বোনের মধ্যে সকলের ছোট। বাবা হরনাথ প্রসাদ নিষ্ঠাবান একজন ব্যাংককর্মকর্তা। মা কাননবালা প্রাইমারি স্কুলশিক্ষিকা। দিদির প্রকাশনাম তৃষা। লিখিতনাম শ্রীমিতা দেবী। বিয়ে হয়েছে এক বছর পূর্বে এক বিত্তবান পরিবারে। থাকে স্বামীর সঙ্গে অস্ট্রেলিয়ায়। বড়দাদার নাম অতুলনাথ প্রসাদ। থাকে গ্লাফে। তেমন সুবিধা করতে পাচ্ছে না। মা বারবার হুকুম জানাচ্ছে ফেরত আসতে, সম্ভবত চলে আসবে। ছোটদাদার নাম প্রতুলনাথ প্রসাদ। বর্তমানে বিএ পড়ছে। বীরেন্দ্রনাথকলেজে ভর্তি হয়েছে, থাকে ছাত্রাবাসে। সংসার একেবারে ঝঞ্ঝাটমুক্ত বলা যায়।
ইদানীং অনি আর বর্ষা কোনো-না-কোনো জায়গায় বা পার্কে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা প্রেমের আলাপে মশগুল। একে অপরকে দিনদুয়েক না দেখলে মনে হচ্ছে যুগযুগের সমান। বর্ষার হাতে কোনো মুঠোফোন নেই। বাবামার ফোনে কথা বলা ত দূরের কথা, হাত লাগানোরও অনুমতি নেই। এ পরিবারে মেয়েদেরকে খুব কড়া নজরে রাখা হয়। বাবা হরনাথের ধারণা, মোবাইলই একমাত্র পড়ুয়া ছেলেমেয়েদের নষ্টের গোড়া। মা কাননবালাও স্বামীর সঙ্গে একমত। বর্ষা কলেজ যাওয়া-আসাতে অপরিচিত ফোনের দোকান থেকে অনির সঙ্গে জরুরি কথাবার্তা সাড়ে। তারপর নির্দিষ্ট স্থানে মিলিত হয়। আজ সকালে কলেজ যেতে কথা হয়েছে বিকাল চারটায় জগন্নাথোদ্যানে আসার। অনির ছুটি তিনটায় তবে এখানে আসতে হলে গাড়ির ঝঞ্ঝাটে ঘণ্টাখানিক লেগে যায়। কখনো বর্ষার একটু দেরি হলে আবার কখনো অনির–তবে বেশির ভাগ অনিরই হয়। কারণ সে একটা দায়িত্বে নিযুক্ত। আজ কারও বেশিক্ষণ দেরি হয় নি, পাঁচ-সাত মিনিটের ব্যবধান। তবু অনি একটু পরে আসাতে দুঃখপ্রকাশ করল–বলল, দুঃখিত লক্ষ্মীটি, অনেক চেষ্টা করছি–আশা ছিল আজ তোমার আগে আসবই আসব কিন্তু বাংলাদেশের জ্যামের যে অবস্থা রে বাবা! আমার কপালটাই মন্দ–বলে দুহাতে বর্ষার মুখখানি ধরে আলতোভাবে ঠোঁটে একটা চুমু খেল। বিনিময়ে বর্ষাও একটা দিল। খুব হাসিমাতি ঠাট্টামশকরা বেশ কতক চলল। এবার দুজন ধীরে ধীরে হাঁটতে লাগল। হঠাৎ বর্ষা বলল, অনি নামটা আমার কেন জানি ভাল লাগছে না আর, তোমার একটা নাম দিতে চাই; যে নামটা হবে একান্ত আমার আর কারও নয়।
অনি কোনকিছু জিজ্ঞেস না করে কৌতুকের সঙ্গে বলল, তাড়াতাড়ি দাও-না প্রিয়ে, শোনার জন্যে অধমের কর্ণ যে একেবারে ধৈর্যহারা হয়ে আছে।
বর্ষা কোনো চিন্তা না করে বলল, অন্ত। আবার একটু চিন্তা করে বলল, না না, ওটা নির্দিষ্ট একটা সীমারেখায় শেষ হয়ে যায়। তোমার নামের ‘অ’র পরে একটা ‘ন’ বাড়িয়ে তাকে করব অসীম আর তুমি হবে আমার অনন্ত।
অনি বলল, বাহ্ চমৎকার ত! তা হলে তোমারও যে একটা নাম দিতে হয়–কী নাম দেওয়া যায় বল দেখি? অনিও একটু ভাবল–ভেবে বলল, সাধনা। আমি তোমার অনন্ত তুমি আমার সাধনা। আজ থেকে আমরা অনন্তসাধনা। নামটা কেমন হল বলবে না?
বর্ষা হেসে বলল, তুলনাহীন। তারপর দুজন নির্জন একটি গাছের তলায় বসল।
সাধনার কোলে মাথা রেখে অনন্ত শুয়ে আছে ঘাসের উপরে। এমন অপূর্ব ভালবাসায় বোধহয় প্রকৃতি সজীব। ফুলচয়-পশুপাখি-লতাপাতা-ঘাস–সৃষ্টির সমস্ত সৃষ্টি মনে হয় এ ভালবাসার কাছে বন্দি। এ জগৎসংসার ভালবাসারই সৃষ্টি? প্রায়ই নির্জন এ পার্ক প্রেমিকপ্রেমিকার জন্যে স্বর্গীয় এক বাগান বলা যায়। তার রূপের বর্ণনা করতে গেলে পাথেয় শেষ হয়ে যাবে কিন্তু পথ শেষ হবে না, তাই পাথেয় ফুরিয়ে যাওয়ার আগে পথের সমাপ্তি জরুরি। বর্ষা বলল, এভাবে আমাদের মিলামিশা আর কত দিন–ভাল মনে হচ্ছে না। আত্মীয়জনদের কেউ যদি দেখে পেলে, অন্তত আমার রক্ষা নেই।
অনি বলল, আমার রক্ষা করবে কোন্ বিধাতায়?
বর্ষা সামান্য হেসে দীর্ঘশ্বাস ফেলল–বলল, তোমার পরিণতি যাই হোক, আশা করি আমার মতো হবে না।
সত্যকে সত্তর পর্দার আড়ালে ঢেকে রাখলেও সত্য একদিন উন্মোচন হবেই। এ গোপনীয়তাকে আর বেশিদিন গোপন রাখা গেল না। কারণ তাদের প্রেম এতটাই গাঢ় হয় যে, দুই পরিবারের পরিজনমহলে জানাজানি হতে দ্রুত কানাকানিতে নেমে আসে। বর্ষাদের স্বজনরা ধিক্কারশব্দে-হুঁ…হাঁ…একটা ম্লেচ্ছকে…কেউ বলছে, স্বজাতিতে এতই কি অভাব হয়েছে যে, একজন বিজাতিকে নিয়ে ঘর করতে হবে? ছি, লজ্জাশরম সংসার থেকে একেবারে উঠে গেল নাকি! ইত্যাদি ইত্যাদি বলে বর্ষার মাবাবাকে লজ্জা দিচ্ছে। তারপর নিন্দুকের মুখে মুখে রচিত হচ্ছে বার হাজার নিন্দার আখ্যান।
এদিকে অনির পরিবারবর্গে তেমন একটা হইহুল্লোর শুনা যাচ্ছে না। কারণ ওদের পরিবারে আছেইবা কে–মায়ের দিক থেকে গুটিকয়েক আত্মীয়। মামামামিরা ও খালাখালোরা। তার পরেও দুয়েক কথা শুনতে হয় নি এমন কথা নয়।
মামারা গোস্বায় লালনীল হয়ে বলছে, এমন বিজাতি…আমাদের সমাজে স্বীকৃতি নেই।
মামিরা তেলেবেগুনে জ্বলে তার মায়ের কান ভরছে, চৌদ্দ গোষ্ঠীর মান-ইজ্জত ডুবাবে আরকি। নাহয় এমন বিধর্মীকে নিয়ে কেউ ঘর পাততে চায় বুঝি! তার বাপের ইজ্জত না থাকলেও না থাকতে পারে কিন্তু আমাদের আছে। তুমি তোমার ভাইদের সম্মান ভেসে দিতে পার না। এমেয়ে বিয়ে করলে তুমি বিষ খাবে বল।
দুই পরিবারেতে কমবেশি অমন কানাঘুষা প্রতিনিয়ত চলছেই। এবার ভাইবোনদের কথামতো বর্ষাকে ঘরবন্দি করে স্কুল যাওয়া পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। অনির সঙ্গে কোনোপ্রকার যোগাযোগ করবে থাক, তাকে কল্পনা করাও নিষিদ্ধ। বর্ষা পাগলপ্রায়। অনিও তাই। এভাবে তারা মণিহারা সাপের মতো কাটছে কিছু দিন। আরেকদিন হঠাৎ জানতে পারে আকাশ ভেঙে মাথায় পড়ার কথা, পৃথিবী ফেঁটে চৌচির হওয়ার খবর, গোপনে বর্ষাকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে পিসির শ্বশুরবাড়ি কলকাতায়! পাওয়া যায় ঘনিষ্ঠা বান্ধবী শ্রেষ্ঠার কাছে রেখে যাওয়া বর্ষার একখানা কাব্যচিঠি–
হাজার বছর পরে
হয়তো আবার দেখা পাবে আমার
এ করুণার বাসভূমে হয়তো আর আসব না ফিরে
এ বাংলার লোকালয় তখন হয়তো রবে না
রবে না হয়তো বাংলাদেশের কোনো চিহ্নপ্রতীক।
রবে না
রবে না হয়তো জাতিভেদের কোনো ভেদাভেদ
রবে না রবে না হয়তো মানুষে মানুষে বিবেদবিদ্বেষ
রবে না মৃত্তিকায় কেউ রবে না অট্টালিকার আত্মগরিমায়
ধনীগরিব উঁচুনিচু আর্যানার্য প্রভেদ ভুলে মনুষ্যজাতি হবে এক।
তখন?
তখন হয়তো পৃথিবীর আরেক দেশে জন্ম হবে আমার অন্যরূপে
তুমি হবে আরেক–হয়তো রবে দূরে–কিবা–তবু হৃদয়ের কাছে
তোমার আঙিনার হলুদবনে গুলঞ্চলতার ফুলটিরে ভালবাসবে তুমি
হয়তো সে আমি, অনুভবে সকল অনুভূতি করবে বন্ধু স্মরণ–
তখন?
খুঁজে দেখো ঐ পথের ধারে কলমিডাঁটায় বসে আছে যে ফড়িং
তোমার বাড়ির উঠানে শজনেগাছে বসে আছে যে হলুদ পাখিটি
কিবা বসে আছে পেয়ারাডালে, বারবার উঁকি দিচ্ছে ওই ঘুলঘুলিতে
অথবা তোমার চলার পথে দ্রোণ হয়ে জড়িয়ে আছে পায়ে
টের পাবে না বন্ধু!
যে ভালবাসার সমাধি হয়ে চলে যাচ্ছি গহিনারণ্যে
জেনে রেখো প্রিয়, সেখানে আমার কবর–
এই যে এ বিদায়ের পল, এই যে অপূর্ণ ভালবাসাবিকল
যদি কখনো পূর্ণ হয়–হোক তবে ওই ধরাধামে
চিরানন্দের ভবে।
এ জগজ্জড়তার ছত্রছায়ায় চাই না একবিন্দু ঠাঁই
চাই না নির্দয়ের কাছে করুণার কড়িমাত্র পাথেয়
চাই না বিরূপ এ চরাচরে মানবরূপে জন্ম নিই আবার
ধর্মান্ধতার যাঁতাকলে বলির মৃগ হতে চাই না পুন।
বন্ধু!
আমায় যদি মনে পড়ে–তবে দেখো ওই নক্ষত্রের ধারে
খদ্যোতাভায় জ্বলছে মিটিমিটি–দলেদলে করছে নর্তন
হয়তো সেখানে আমি একজন আলোর মশাল জ্বেলে
প্রিয়তমের প্রতীক্ষায় বসে আছি আহ্লাদে শুধু আহ্লাদের ঘরে।
মনে রেখো,
সেদিন ফুটবে না আর কোনো বেদনার নীলোৎপল
আসবে না আর কোনো বিদায়ব্যথার করুণমুহূর্ত
যেতে হবে না দূরে–অনেক দূরে প্রিয়জন ছাড়ি
আজ যেতে বাধ্য–আমি নিরুপায় সামর্থ্যহীন।
বন্ধু যাই–
অপরাধী আমি নই, তবে ভাবো যদি অপরাধী
মানি বিধিলিখন ধন্য তবে ধিক্কারের বাণী যদি পাই
আবার জন্ম যদি সত্যি হয় চাই না এ হিংস্রজীবন
পুনর্জন্মে যদি আসি মাছরাঙা হয়ে ওই নদীটির কিনারে
ধন্য সেই জনম।
পড়তে পড়তে অনির চোখের জলে চিঠিটা কবে ভিজে গেল টের পাওয়া যায় নি। একবার ভাঁজ করে রেখে দেয় পকেটে। আবার বের করে চুমু খায় : দুচোখে ঠেকায়–আবার পড়ে। মাতাল যেমন মদের নেশায় টলতে টলতে বার শ রাজ্যের স্বপ্ন দেখে এবং বার হাজার দেশের মালিক বনে একসময় হুঁশহারা হয়ে পড়ে, তেমন স্বপ্নের মালিক না হলেও একমাত্র সম্পদ বুকে চেপে অনিও স্মৃতির রাজ্যে টলমলাতে টলমলাতে হুঁশহারা হয়ে যায় কখনো কখনো। এভাবে দীর্ঘদিন না চললেও কিছু দিন পাগলের মতো চলছে…
এখান থেকে বর্ষার এক নতুন অধ্যায় শুরু। প্রত্যেক মানুষের মনে যে একজন কবি লুকানো থাকে তার প্রমাণ আমরা বর্ষার এ একখানা চিঠির মাধ্যমে দেখতে পাই। মানুষ বলতেই কিছু-না-কিছু প্রতিভার অধিকারী আর এ অধিকার কোথায় গিয়ে কীভাবে মিলবে ঈশ্বর ছাড়া পৃথিবীর কোনো মানুষ বলতে পারবে না।
অনির মনের অশান্তি আর দুঃখদুর্দশায় প্রায় বার বছর কেটে গেল, একবিন্দু শান্তি অনুভব করতে পারল না বিগত জীবনে। ইতোমধ্যে–মা মরে গেল। আরেকদিন আদরের বোনটিকেও বেঁধে দিতে হল চিরবন্ধনের ডোরে। অতঃপর বড়ই একা–এ একাকিত্ব জীবন আর ভাল লাগছে না। অস্থির মন কী করবে বুঝে উঠতে পারছে না, এবার উদ্দেশহীন যাত্রা–শুরু হল বৈরাগ্যজীবন। আজ এখানে ত কাল ওখানে–গ্রাম হতে গ্রামান্তরে, দেশ হতে দেশান্তরে। কোথায় যাত্রাবসান–শেষঠিকানা কোথায় কে জানে। এ-ই দীর্ঘ দাড়িগোঁফ, লম্বা চুলে ধরেছে পাক। মলিন বস্ত্র পরিধানে চলছে…চলছে…চলছে…সুদীর্ঘ পথ অতিক্রম করে এক আশ্রমের দ্বারে এসে চলন শেষ! এক শ চার ডিগ্রি জ্বরের তাপমাত্রায় স্থির হয়ে দাঁড়াতে পারছে না আর। কাশিতে বন্ধ হয়ে আসছে বুকের দম। সমস্ত শরীর ব্যথায় জর্জরিত। এবার মাটিতে লুঠিয়ে পড়ল রুগ্ন দেহ। লুণ্ঠিতের দুচোখ বেয়ে বয়ে যাচ্ছে নীরবে হাজার বেদনার কান্নাশ্রু। রমণীজনা এসে কোলে তোলে নিল পতিতজনের মাথা। চোখের জলে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে না রমণীর মুখ। স্নেহের আঁচলে মুছে দিচ্ছে রমণী পান্থের চোখের পানি। তৎক্ষণাৎ শুরু হল প্রাকৃতিক বিপর্যয়, মুহূর্তে পৃথিবী অন্ধকার হয়ে নেমে এল কেয়ামতের দুর্যোগ। তিন শ বত্রিশ কিলোমিটার বেগে ছুটছে বাতাস। প্রকৃতির সৌন্দর্য মিশমার করে বোধ হয় এক্ষুনি নিয়ে যাবে নিজের আস্তানায়। এ দুর্যোগের ঘনঘটায় ক্লান্তের রুগ্ন শরীরে অনুভব হতে লাগল অশ্বের শক্তি। এবং দৃষ্টিক্ষীণ চোখের আলো যেন হয়ে যাচ্ছে প্রখর। বর্ষাকে সহজেই চিন্তে পারছে অনি। আশ্চর্য অনুভব করে অপূর্ব ভালবাসার কণ্ঠে ডাকল, সাধনা! একে অপরকে ঝাপটিয়ে ধরল বুকে! আজ চব্বিশ বছর পর যেন স্বপ্নের জগতে প্রবেশ করল বর্ষা। বিশ্বাস কেমন করে হয়। মানুষ যেখানে সাধারণ কিছুকে সহজে বিশ্বাস করতে পারে না, সেখানে অসাধারণকে বর্ষা কীভাবে বিশ্বাস করে। চারি দিকে চোখ ঘুরিয়ে দেখে–না না, সবদিকে ঠিক আছে প্রকৃতি। বন্ধ হল বাতাসের গতি! হাজার প্রশ্নের সমাধি থেকে তাদের একটিমাত্র প্রশ্ন জাগরিত হয় দুজনার মনে : করতে চায় পৃথিবীকে–সমস্ত সৃষ্টির মালিক যেখানে রাখে নি প্রভেদ, সেখানে সৃষ্টি কী অধিকারে করছে ভেদাভেদ? কান্নার জলে ভেসে যাচ্ছে দুজনের চোখ। অনি কাশতে কাশতে অতি ক্ষীণকণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, কেমন আছ সাধনা? কণ্ঠে তার অপূর্ব ভালবাসার দরদ। বর্ষা চুমুই চুমুই ভরে দিল অনির মুখ। পৃথিবীটা স্বর্গ হয়ে দেখা দিল আবার দুজনার মনে…
বর্ষা কেঁদে বলল, অনন্ত! কোনদিন কল্পনা করি নি প্রিয় নামটা আবার ডাকতে পারব।
অনি দরদভরা কণ্ঠে বলল, প্রিয়ে! পৃথিবীটাই ত একটা অঘটনের জায়গা, যা কল্পনা করা হয় তা কখনো ঘটে না; যা ঘটে যায় তা কখনো কল্পনা করা হয় না। মনে রেখো, প্রেমের জন্যে সৃষ্টি–সৃষ্টির জন্যে প্রেম নয়। অনির গলার স্বর ক্ষীণ হয়ে আসছে তবু কৌতূহলীকণ্ঠে অপূর্বতার দরদ…
বর্ষা কান্নামিশ্রিতগলায় বলল : সেই অনেক কথা–আমাকে জোর করে বিয়ে দিতে চেয়েছিল তারা। এক সুযোগে রাতের অন্ধকারে পালিয়ে আসি। ভাগ্যক্রমে এ আশ্রমের কর্ত্রীর নিকট আশ্রয় পাই। বড়ই মহতী ছিলেন নিঃসন্তান এ মঠকর্ত্রী। আমাকে নিজসন্তানের মতো ভালবাসতেন। তারপর আমার হাতে আখড়ার ভার সোপর্দ করে আরেকদিন চলে গেলেন ঈশ্বরের ডাকে। সংক্ষিপ্ত এটুকু বর্ণনাশেষে যখন বলতে লাগল–চল মঠে যাই। ততক্ষণে অনির চোখে ঘুম এসে গেছে। দেখা গেল, এ তো কোনো সাধারণ ঘুম নয় জীবনের একমাত্র নিদ্রা–শেষ ঘুম!
আর একফোঁটা চোখের জল বিসর্জন দিতে হল না বর্ষার। একটুপর টলে পড়ে তার নিথর দেহ অনির বুকের উপর। সঙ্গে সঙ্গে স্তব্ধ হয়ে যায় পৃথিবীর নাড়ির বন্ধন! থেমে যায় সব কোলাহল! মিটে গেল অনন্তসাধনার অপূর্ব ভালবাসা।
তারপর আখড়ার লোকজন এসে অনির লাশের উপর রহস্যভেদের তাণ্ডব : অপরিচিত জন–হিন্দু-না-মুসলিম, বৌদ্ধ-না-খ্রিস্টান…
বর্ষার হতভাগ্যকপাল। হতভাগ্য এ জন্যে যে, এ সমাজে না সে মানুষ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে, না প্রতিভাশালী হিসেবে। পৃথিবীতে বর্ষায় সম্ভবত একমাত্র কবি বা লেখক, যে মৃত্যুর অনেক দিনপর পরিচিতি পেয়েছে। ভাল কর্মের ফল সব সময় ভাল। চুপকথা ছদ্মনামে যে গল্প-কবিতা-প্রবন্ধ-নিবন্ধ সে লিখে গেছে, আমাদের সাহিত্যভাণ্ডারকে করেছে আরও সমৃদ্ধ। আমরা চুপকথার যত লেখাই পড়ছি ততই মুগ্ধ হচ্ছি! সাহিত্যজগতে আজ অমূল্য সম্পদ হিসেবে গণনা হচ্ছে চুপকথার রচনাবলী।
১০ শ্রাবণ, ১৪১৮ সাল, চট্টগ্রাম।