জীবন চক্র(গ্রীষ্মে)১ম পর্ব
গ্রীষ্মে
বৈশাখ মাসের রোদেলা দুপুর।আম গাছের নিচে পাতা মাচানে বসে পান চিবুচ্ছেন রহম আলী। সারাদিন কলা বাগানে খেটে এসেছেন। নিজের এক চিলতে জমিন। তার উপর ভরসা করে চলতে হয় পুরো বছর। কোন কোন বছর বেশ ভালো চলে । আর কোন কোন বছর অনেক কষ্ট সহ্য করতে হয়। এসব সব উপরে ওয়ালার খেলা বলে মানেন রহম আলী।
বাপ মারা গেছে সেই ছোট বেলায়। মা জন্মের সময়। সেই থেকে ফুফুর বাড়ীতে মানুষ হতে হতে নিজের বাড়ী হয়ে গেছে অশ্বথতলা গ্রাম। গ্রামের এই নামের পেছনে ছোট একটা ইতিহাস আছে। গ্রামের ঠিক মাঝ খানে একটি অশ্বথ গাছ আছে । যার বয়স সঠিক কত তা কেউ জানে না । সকলে ধারনা করে এই গাছটির উপর ভিত্তি করে কেউ হয়ত এই গ্রামের নাম রেখেছে অশ্বথতলা । সেই কারনে প্রতি বছর বৈশাখী মেলা এই অশ্বথ গাছের তলায় হয়। বাড়ীর পাশে মেলা হলে ও সেখানে তেমন একটা যেতে পারেন না রহম আলী।
সংসারে এক মেয়ে আর দুই ছেলে । বউ গত হয়েছে চার বছর হল। বড় ছেলে বিয়ে করে শ্বশুর বাড়ী থাকে ঘরজামাই হয়ে । ছোট ছেলে বাজারের হোটেলে কাজ করে । মাঝে মাঝে সংসারে কিছু দেয় । মেয়েটার বিয়ের বয়স হয়ে আসছে । সে ব্যাপারে রহম আলীর যত চিন্তা । এবারে কলা’র ফসল সহিসালামতে তুলতে পারলে মেয়েটার একটা ব্যাবস্থা করবেন বলে মনে মনে স্থির করেছেন। বাঁশের মাচানের উপর বসে আনমনে এসব ভাবছিলেন রহম আলী । কখন যে তার মেয়ে জয়নাব এসে তার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে সেই খেয়াল নাই।
ও বাবা !কি ভাব?
কিছু নারে মা (চমকে উঠে )
খানা খাইতে আস।
হ্যাঁ আইতাছি , তুই যা।
ঠিক আছে বাবা। জলদি আইসো কিন্তু।
রহম আলী খেতে বসেছেন। তার সামনে কিছু ভাঙ্গা চাউলের (খুদ)ভাত ।সাথে হেলেঞ্চা শাক। এই খাবার বেশ তৃপ্তি নিয়ে খাচ্ছে রহম আলী । খাবার নিয়ে তার কোন অভিযোগ নেই ।যেদিন যা জোটে তাতেই খুশী। কিন্তু মেয়েটার জন্য কষ্ট লাগে। কিছু কষ্টের কখনো প্রকাশ হয় না , যা নিজের মনে থেকে যায়। হেলেঞ্চা শাকে লবন বেশী হয়েছে কিন্তু তিনি কিছুই বলছেন না । মা মরা মেয়ে , কষ্ট করে পাকায় তাইতো বেশী।
জয়নব মা , একটি শুকনো মরিচ দে।
মরিচ তো নাই বাবা। আজ তো মরিচ চাড়া পাকিয়েছি।
আচ্ছা লাগবে না মা। বিকালে বাজারে গেলে মনে করে দিস। মরিচ নিয়ে আসব।
ঠিক আছে মনে করিয়ে দেব।
গ্রীষ্মের দাবদাহে চারদিক অনেক শুষ্ক।পাকা আমের ঘ্রান সারা গ্রামময়। পড়ন্ত বিকেলে নিজের কলা বাগানে কাজ করছে রহম আলী। আগাছা পরিস্কার করছে , সার দিচ্ছে বড় এবং মোটা গাছ গুলো কে বাঁশের খুটির সাথে আটকে দিয়েছে । যাতে করে ঝড় তুফান এলে কলাগাছের কোন ক্ষতি না হয়। ভয় শুধু কালবৈশাখী কে। কলাবাগানের কলা বেচে ব্যাংকের ঋণ শোধ দিতে হবে, তারপরে মেয়েটার বিয়ে । এসব ভাবতে ভাবতে সময় পার হয়ে যায়। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামে প্রতিদিনের মত আজো বাজারে যাওয়ার কথা ভুলে যায় রহম আলী।
রাতে বাড়ী ফিরে এলে মেয়ের প্রশ্নে বাজারে যাবার প্রসঙ্গ মনে হয় রহম আলীর। সন্ধ্যার পর থেকে ঝড়ো হাওয়া বইছে। রহম আলী ভীষণ চিন্তিত। মেয়েকে ঘুমিয়ে থাকার কথা বলে নিজে ঘরের দাওয়ায় বসে থাকে । সাঁ সাঁ শব্দে বাতাস বইছে। বাড়ির পাশের সুপারি গাছের মাথা গুলো নুয়ে মাটি ছুঁতে চায়। রহম আলী বুঝে এবার সব শেষ । কলা বাগান বুঝি আর রক্ষা পেল না। ছুটে চলেন কলা বাগানের দিকে। ঝড়ের ঝাপটায় বেশ কিছু কলা গাছ ভেঙ্গে গেছে। রহম আলী পাগলের মত হয়ে এদিকে সেদিকে দৌড়াদৌড়ি করতে লাগলেন। তার মেয়ে জয়নাব কখন কলা বাগানে চলে এসেছে তা তিনি খেয়াল করেননি। বাপ বেটি মিলে সর্বনাশ ঠেকাতে প্রাণান্ত চেষ্টা করতে লাগলেন। কিন্তু কালবৈশাখী কি তাদের আকুতি শুনে। প্রায় চার ঘণ্টার তাণ্ডব লীলার পর কালবৈশাখী ঠাণ্ডা হল রহম আলীর কলাবাগানের চরম সর্বনাশ করে। রাতের বেলায় কলা বাগানের পাশে বসে বিলাপ করতে লাগল রহম আলী ।
আমার সব শেষ হয়ে গেছে খোদা, আমার সব শেষ হয়ে গেছে।
জয়নাব বহু কষ্টে তার বাবাকে একরকম টেনে হিঁচড়ে ঘরে নিয়ে এল ।
(চলবে)