Today 10 Oct 2025
Top today
Welcome to cholontika

ধারাবাহিক উপন্যাস “নরক”(পোঃ৪)

: | : ০১/০৭/২০১৩

(গতকালের পর)–

বাবার এই কথাটি শোনার সাথে আমার শরীরের সবগুলো লোম খাড়া হয়ে গেল, আমি শিউরে উঠলাম। কী এমন কথা, যা তিনি দশ বছর ধরে চেপে রেখেছেন। এর আগে তো বাবা কোনো কথাই আমার সাথে সেয়ার করতেন না। আজ হঠাৎ কী এমন প্রয়োজন পড়ল ?
আমি মনে মনে হিসাব কষতে শুরু করলাম, দশ বছর আগে আমাদের সংসারে স্মরণীয় কিছু ঘটে ছিল কিনা ? বাবা তার দ্বিতীয় কথা শুরু করার আগেই পেয়ে গেলাম, দশ বছর আগে আমার মা মারা গিয়েছে। তবে মা-র ব্যাপারে বাবা কিছু বলবেন বলে মনে হচ্ছে না। সন্তানদেরকে না জানিয়েই যে বাবা তার সন্তানের মা-কে দাফন করতে পারেন, সেই বাবা সন্তানদের কাছে সেই বিষয়ে কোন মুখে আলোচনা করবেন ?
আমার সব অনুমানকে তুচ্ছ করে বাবা তার দ্বিতীয় কথা শুরু করলেন, তোমরা তো কখনোই জানতে চাইলে না তোমাদের মা কীভাবে মারা গিয়ে ছিল ? আমিও নিজে থেকে বলি নি। তবে আজ বলাটা জরুরী হয়ে দাড়িয়েছে। তোমাকে সব জানতে হবে, কারণ তোমাকে নিয়ে তোমার মায়ের অনেক আশা ছিল।
এ পর্যন্ত বলেই বাবা হুক্কায় টান দিলেন। আবার কাশি শুরু হয়ে গেল। আমিও ভাবনায় পড়ে গেলাম, আমাকে নিয়ে মা-র কী এমন আশা ছিল ? বাবার মুখে পরবর্তী কথাগুলো শোনার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠলাম।
কাশি থামার পর অতৃপ্তির সাথে হুক্কার পাইপ নামিয়ে রাখলেন। তরপর ধীরে ধীরে বলতে শুরু করলেন, তোমার মা মারা গিয়েছে কলেরায় আক্রান্ত হয়ে। সেই রাতে আমি তোমাদেরকে আনতে যেতে চেয়েছিলাম, কিন্তু তোমার মা বাঁধা দিয়েছিল। তবে তোমার মা মারা যাবার আগে যা যা বলেছিল তা কখনই ভুলতে পারব না। আমার কোলে দম ছেড়ে দিলো। মানুষ যে এত তাড়াতাড়ি নিঃশেষ হয়ে যেতে পারে চোখে দেখার পরও বিশ্বাস হয় না। সফিউল্লাহ আর আক্কাসের বাড়িতে গুড় আর চিড়া দিয়ে ফিরেছি আমি আর তোমার মা। হাত মুখ ধোয়ে আমি চেয়ারে বসেছি । কিছুক্ষণ পর তোমার মা বাহিরে গেল। সেই যে গেল আর ফিরে নি। সম্ভাবত বাথরুমে গিয়েছিল। দরজায় এসে হামাগুড়ি দিয়ে পড়ল। আমি দৌড়ে গিয়ে ধরলাম। মানুষ যে এত তাড়াতাড়ি নিস্তেজ হয়ে যেতে পারে এটা অকল্পনীয়। যেতে যেতে অনেক কথাই বলে গেল তোমার মা, যার একটিও আমি পূরণ করতে পারি নি। শেষ নিঃশ্বাস গুনতে গুনতে আমার হাত ধরে বলল, তোমার তো কোনো উচ্চাবিলাষ নেই, বড় কোনো চাওয়া নেই, এত সম্পদের মালিক হওয়া সত্বেও অতি সাধারণ জীবন যাপন কর। মানুষের সুখ দুঃখে তাদের পাশে থাকার চেষ্টা কর। পারলে আমার একটা অনুরোধ রেখো।
আমি তখনো বুঝতে পারি নি তোমার মা মারা যাচ্ছে ! কোলে করে ঘরে নিতে চাইলাম তাও বারণ করল। তারপর ধীরে ধীরে বলল, মানুষের বিপদে আপদে তোমার মন কাঁদে বলে বলছি। জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছ বলে বলছি। দেশের মানুষের অপমৃত্ত্যু তোমার সহ্য হয় না বলে বলছি। তোমার নিজের যেহেতু সম্পদ ভোগের লালসা নেই । একটি মাত্র ছেলে তোমার, তার দিন কোনো না কোনোভাবে কেটেই যাবে। যদি পারো এই এলাকায় একটি হাসপাতাল করো।
আর কিছু বলল না, চোখ বন্ধ করে ফেলল। তোমার মায়ের শেষ কথাটি আমাকে অনেক ভাবাল। কী এমন সম্পদ আছে আমার ? তা দিয়ে কি হাসপাতাল বানানো সম্ভব ? আর হাসপাতাল হলেই বা কয়দিন চলবে ? শহরের ঢের সুবিধা বিসর্জন দিয়ে ডাক্তারগণ এই অজোপাড়া গাঁয়ে এসে থাকবেন কেন ? ইত্যাদি নিয়ে আমাকে অনেক ভাবতে হল। অনেক হিসেব নিকাশ কষে একটি উপায় খোঁজে পেলাম। আর সেই উপায় হলে তুমি।
বাবা ফের কাশতে শুরু করেছেন। আমারও ভাবার কথা, আমি ! আমি আবার কিসের উপায় ? কিন্তু এসব নিয়ে আমি এখন ভাবছি না। আমি ফিরে গিয়েছি দশ বছর আগের সেই ভয়াল রাতে, যে রাতে ভয়াবহ কলেরার থাবায় হারিয়ে গিয়েছে আমার মাসহ আরো অনেকের জীবন। মায়ের কাতর মুখখানি চোখের সামনে ভেসে উঠছে। আমার মায়ের মতন অসহায় কয়জন ছিল সংসারে ? সাধ্য থাকা সত্বেও যে কিনা মৃত্ত্যুর আগে সন্তানের মুখ দেখে যেতে পারল না শুধু মাত্র সন্তানদের মঙ্গলের কথা চিন্তা করে। এত বড় ছাড় মা ব্যতিত পৃথিবীতে আর কারো পক্ষে দেয়া সম্ভব নয়। এজন্যই বোধ হয় মাকে ঈশ্বরের আরেক রূপ বলা হয়।
আমি হয়ত কাঁদতে ছিলাম। ভাবনার জগৎ ছেড়ে যখন বাস্তবে ফিরে এলাম, দেখলাম বাবা আমাকে তার বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে রেখেছেন। তারপর বাবা যা করলেন পৃথিবীর অন্যকোনো বাবা তার সন্তানের সাথে এমনটি করেছেন কিনা আমি জানি না।
বাবা মা সব সময় সন্তানের ভবিষ্যৎ তৈরী করেন, সন্তানকে সর্বদা সুখি দেখতে চায়, সন্তানের জীবনকে নানা রঙে সাজাতে চায়। জলচৌকিতে বসেই বাবা আমার ভবিষ্যৎ রচনা করলেন। একেবারে ব্যতিক্রম ভবিষ্যৎ, যা অন্য কোনো বাবা তার সন্তানের জন্য কামনা করতে পারেন না। তুলির আঁচড়ে আঁচড়ে আমার জীবন সাজালেন, তবে রঙ্গিন নয় একেবারে শাদামাটা জীবন।
মা বাবা সন্তানের কাছে ভালোবাসা চায়, সম্মান চায়, শেষকালে ভরণ পোষণ চায়। কিন্তু আমার বাবা এসবের কিছুই চাইলেন না। একেবারে জোড় হাত বাড়িয়ে আমার জীবন চাইলেন।
আমার মাথা আউলে গেল, মগজ কাজ করা ছেড়ে দিলো। ক্ষনিকের জন্য জ্ঞানশক্তি স্থিত হলেও এতটুকু আন্দাজ করতে পারছি, বাবার মতন লোক মানুষ তো দূরের কথা একটি পিপড়াও হত্যা করতে পারবে না এটা চরম সত্য। কিন্তু আমার জীবন দিয়ে তিনি কী করবেন ?
আমার হাত টেনে নিয়ে নিজ মাথার উপর রেখে বললেন, তোকে শুধু আমার একার প্রয়োজন নয়, এই গ্রামের প্রতিটি মানুষের প্রয়োজন। বল, আমি যা বলব তুই তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করবি। আমার মাথায় হাত রেখে শপথ করে বল।
এই প্রথম বাবা আমাকে তুই করে বলছেন। মানুষ তাকেই তুই সম্বোধন করে যাকে তার অনেক বেশি আপন, নতুবা নিতান্তই পর মনে হয়। বাবা আমাকে কেন তুই করে বলছেন তা বলতে পারব না। নিজের অজান্তেই আমি সম্মতিসূচক ঘাড় নাড়ালাম।
বাবার চোখ থেকে দুই ফোঁটা অশ্রু ঝরে পড়ল। এই অশ্রু সুখের না দুঃখের বুঝতে পারলাম না। ধীরে ধীরে তার মুখের বিষন্নতা কাটতে শুরু করল। এক সময় মুখশ্রীতে নূরানী ভাব ফুটে উঠল। তারপর অনেক কিছুই বললেন, শুরু করলেন কয়েকটা প্রশ্ন দিয়ে।
প্রথম প্রশ: তোমার বাবা আফাজ উদ্দিন। তালুকদার না হয়ে, একজন দিনমজুর অথবা হতদরিদ্র ভিখারীও হতে পারত। কি পারত না ?
আমি খাড়া ঘাড় কাঁৎ করে সম্মতি জানালাম।
দ্বিতীয় প্রশ্ন শুধু এই বাড়িটা রেখে বাকী সব সম্পত্তি আমি যদি দান করে দেই, তোমার কোনো আপত্তি আছে ?
আমি আবারো মাথা নাড়িয়ে জবাব দিলাম। তবে এবারের জবাব ছিল নাসূচক।
তারপর ধীরে ধীরে তিনি আমার জীবনের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা বললেন, এতে তুমি খুশি হও আর অখুশি, আমার কিছুই করার নেই। আমাকে কথা দিয়েছ, কথার বরখেলাপ তুমি করতে পারবে না, কারণ তোমার শরীরে বইছে আমার রক্ত। আফাজ তালুকদারের রক্ত কখনো বেইমানি করতে পারে না। এখন যা বলছি তা মনযোগ দিয়ে শোনো, আমি কোনো সাধারণ বাবা নই। আমার মতন পাষাণ বাবা পৃথিবীতে আর একটিও নেই। কোনো বাবাই তার সন্তানের ব্যক্তি স্বাধীনতা খর্ব করতে পারে না, আর আমি তোমার স্বাধীনতা কেড়ে নিচ্ছি। তোমার মাকে কথা দিয়েছিলাম বলেই হয়ত পারছি। আর তুমি তো জানোই আমি সব সময় নিজ সিদ্ধান্তে অটল থাকি। গত দশ বছর ধরে যে স্বপ্ন আমি দেখে এসছি তা তোমাকেই পূরণ করতে হবে। আমার জীবনে আমি যা করতে পারি নি, তোমাকে তা করে দেখাতে হবে। আমি বেঁচে থাকি আর মরে যাই তাতে কিছু যায় আসে না। লেখাপড়া করে তুমি ডাক্তার হবে। চাকরী করার জন্য তুমি ডাক্তার হবে না। শহরে গিয়ে চেম্বার খুলে মোটা টাকাও উপার্জন করবে না। নাগরিক জীবনের বারো আনা সুবিধা শহরের লোকেরা ভোগ করে। তোমার মতন একজন ডাক্তার শহরে না থাকলেও শহরের লোকেদের ডাক্তারের অভাব হবে না। গ্রামের মানুষগুলো বড় অসহায়, পারলে ওদের জন্য কিছু করো, করতেই হবে কারণ আমাকে তুমি কথা দিয়েছ।
বাবা এমন ভাবে কথা বলছেন, মনে হচ্ছে প্রতিটি কথাই তার হৃদয় চিড়ে বেরিয়ে আসছে। কন্ঠস্বর মোটা থেকে অধিকতর মোটা হয়ে উঠছে। আমিও তার প্রতিটি কথা হৃদয় দিয়ে শ্রবণ করছি।
এক ফাঁকে হুক্কার পাইপ হাতে তুলে নিলেন। ততক্ষণে হুক্কার আগুন নিভে গেছে। হুক্কার আগুন জ্বালানোর জন্য করিম চাচা কয়লা আনতে গেলেন। বাকী কথাগুলো তাই তিনি শোনতে পারেন নি।
ফের ওয়াদার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বাবা বললেন, আমার যা সম্পদ আছে, আরো তিন পিড়ি বসে খেলেও ফুরাবে না। অতএব টাকা কামানোর জন্য তোমাকে কিছু করতে হবে না। অন্যরা যেখানে মাছ মাংস দিয়ে ভাত খায়। তুমি সেখানে ডাল দিয়ে খাবে। আমাদের দেশে এখনো অনেক মানুষ আছে যারা দিনে এক বেলাও পেট ভরে খেতে পারে না, তাদেরও তো দিন কাটছে। হালালের শুকনা রুটিও সন্ধেশের মত লাগে । জীবনে কখনো বিলাসিতা করবে না। বিলাসিতা মানুষের বিবেক ধ্বংস করে দেয়। বিবেকহীন মানুষ কখনো পর ব্যাথায় ব্যাথিত হতে পারে না। ডাক্তার হবার পর সারাক্ষণ এই গ্রামেই থাকবে। বিনা পয়সায় এখানকার লোকদেরকে চিকিৎসা করবে। যাতে বিনা চিকিৎসায় তোমার মায়ের মতন আর কেউ মারা না যায়।
এই পর্যন্ত বলেই বাবা থেমে গেলেন। মাথা নিচু করে কি যেন ভাবছেন ? মুখশ্রীতে কিঞ্চিৎ অনোজ্জ্বলতা নেমে এসেছে। তার বিবর্ণতা দেখে আমার অনুমান করতে বিলম্ব হল না যে বাবা এখন কোনো কঠিন কথা বলতে যাচ্ছেন।
খানিক নিরব থাকা পর বাবা তার কঠিন কঠিন বাক্যগুলো উচ্চারণ করলেন, এখন তুমি যেতে পারো, তোমার সাথে আমার কথা শেষ। ঢাকা যাবার প্রস্তুতি নাও গিয়ে। যদি বেঁচে থাকি ডাক্তার হবার পরই তোমার সাথে আমার দেখা হবে, তার আগে না।
সবকিছু শোনার পর আমি শুধু বললাম, ইচ্ছা করলেই তো ডাক্তার হওয়া যায় না। মেডিকেল কলেজেগুলোতে আসন সংখ্যা সীমিত, সহজে চান্স পাওয়া যায় না।
বাবা অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়েই বললেন, তুমি পাবে, কারণ তোমার উদ্দেশ্য সৎ। ভালো লোক কখনো কোনো কাজে ঠেঁকে না।

লেখক সম্পর্কে জানুন |
সর্বমোট পোস্ট: ০ টি
সর্বমোট মন্তব্য: ১ টি
নিবন্ধন করেছেন: মিনিটে

মন্তব্য করুন

go_top