দুঃসাহসী শাহীন (পর্ব-৭)
॥ গোয়েন্দা শাহীন ॥
রুমের দরজার ছিটকিনি খোলার আওয়াজ শোনামাত্র শাহীন দ্রুত ঘুমের ভান করে নাক ডাকা শুরু করে। সেই সাথে আগন্তুকদের দেখার কৌতূহলে চেহারার ওপর হাত রেখে, হাতের এক পার্শ্ব দিয়ে দরজার দিকে সতর্ক দৃষ্টি দেয়। দেখে, আগের ঐ দু’জনসহ তিনজন গুণ্ডা প্রকৃতির লোক রুমে ঢুকছে। এক জনের হাতে একটি দৈনিক পত্রিকা ; আরেক জনের হাতে একটি পলিথিনের শপিং ব্যাগ। তিনজনই শাহীনের বিছানার দিকে অনুসন্ধানী দৃষ্টি দিয়ে রুমের দরজা-জানালাগুলো দেখতে থাকে। শাহীন বুঝতে পারছে, ওরা হয়তো গুরুত্বপূর্ণ কোনো বিষয়ে শলাপরামর্শ করবে। তাই দেখে নিচ্ছে ঘরের পরিবেশ এবং শাহীনেরা ঘুমিয়েছে কি না। তখন তার কৌতূহল আরো বেড়ে যায়। সে খুব সাবধানে নাক ডাকা অব্যাহত রাখে। ওরা শাহীনের নাক ডাকার আওয়াজ শুনে নিশ্চিন্তে বসে পড়ে রুমের এক কোণে। বসেই পলিথিনের ব্যাগ থেকে খাবার বের করে। মনে হচ্ছে মাংস-পারোটা। খেতে বসে শুরু করে আলোচনা। মাঝখানে পলিথিন থেকে তরল জাতীয় কি যেনো গ্লাসে ঢেলে, সবাই একসাথে পান করে। এবারও সেই একই বিশ্রী গন্ধ। শাহীন বুঝতে পারে লোকগুলো নেশাখোর। এখন মদ পান করছে। নেশার ঘোরেও ওরা চালিয়ে যায় আলোচনা।
গুণ্ডা প্রকৃতির ঐ লোকগুলো আলোচনা করছিল, “দৈনিক নতুন পৃথিবী” নামক প্রথম শ্রেণীর একটি জাতীয় পত্রিকায় আজকে প্রকাশিত, আন্তর্জাাতক শিশু-কিশোর অপহরণ ও পাচারকারী দলের নেটওয়ার্ক সম্পর্কিত তথ্যবহুল একটি সচিত্র ফিচার নিয়ে। ফিচারটি প্রকাশের সাথে সাথেই পুলিশের আইজি থেকে শুরু করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পর্যন্ত শুরু হয় তোলপাড়। উপরের কড়া নির্দেশে আজই দু’জায়গায় পুলিশি অভিযান হয়েছে। একটি অপহরণকারী চক্রের কয়েকজন গ্রেফতারও হয়েছে। পুলিশের যে সোর্স মাসিক মাসোহারার বিনিময়ে ওদেরকে সহযোগিতা দিয়ে আসছে, সে ওদেরকে জানিয়েছে যে, ওদের সম্পর্কে স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনে এখনো কোনো তথ্য যায়নি। এছাড়া ওদের রাজনৈতিক গডফাদারও ওদেরকে জানিয়েছে, উপর মহলেও ওদের সম্পর্কে কোনো জানাজানি হয়নি। তবে দু’টি চ্যানেলই ওদেরকে এ মুহূর্তে খুব সাবধান থাকতে বলেছে। ওদিকে ওপারের ক্রেতারাও তাগাদা দিচ্ছে দ্রুত এদেরকে পাচার করে দেয়ার জন্যে। কিন্তু এমনিতেই বর্তমান সরকার সীমান্তে কড়া নজরদারী শুরু করেছে। এখন আবার এই লেখালেখির কারণে সীমান্তের পরিবেশ আরো গরম হয়ে উঠবে। তাই এ মুহূর্তে অন্তত বিদেশে শিশু-কিশোর পাচার করা কিছুতেই সম্ভব নয়। এমতাবস্থায় ভেবে-চিন্তে যথাযথ সিদ্ধান্ত নিতে ভুল হলে, একেবারে মহাসর্বনাশ হয়ে যেতে পারে। তাই ওরা ভীষণ ভাবনায় পড়ে যায়।
বিস্তারিত আলোচনা শেষে ওরা সিদ্ধান্ত নেয়, যেহেতু এখন সীমান্তের পরিবেশ অনুকূল নয় ; সেহেতু ওদেরকে এখন পাচার করার চেষ্টা করবে না। আর ওদের সম্পর্কে কোথাও কোনো তথ্যও যায়নি ; তাই আপাতত ওদেরকে এখানেই রাখবে। পুলিশের সোর্স ছাড়াও ওদের রাজনৈতিক গডফাদারসহ সম্ভাব্য সব চ্যানেলের সাথে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রক্ষা করে চলবে। কোনো রকম সংকেত পাওয়া মাত্র ওঠার জন্যে, একটি বিকল্প বাড়িও এখনই ঠিক করে রাখবে। আর সাবধানতা হিসেবে এখন থেকে এ বাড়ির সম্মুখ দিকের গেটটি পুরোপুরি বন্ধ করে দেবে। ওরাও এ বাড়িতে আসা-যাওয়া এবং আড্ডা বসানো কমিয়ে দেবে। গেটের সামনে অবস্থিত ওদের নিজস্ব হোটেলে বসেই সার্বিক যোগাযোগ রক্ষা করবে। মাঝে-মধ্যে আসা-যাওয়ার জন্যে শুধু মাত্র পেছনের গেটই ব্যবহার করবে। এছাড়া পেছনের গেটও ভিতর থেকে তালা লাগিয়ে চব্বিশ ঘণ্টা পাহারা দেয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এরপর ওদেরই একজনকে লক্ষ্য করে আরেকজন বলে ঃ
এই কাল্লু, এখন থেকে তুই পিছনের গেটে ডিউটি করবি। খুব কড়া ডিউটি করবি। গেট ছেড়ে কখনো কোথাও যাবি না – বুঝলি?
তখন আরেকজন জবাব দেয়, হুঁ ঠিক আছে। তোমরা ঠিকই বলেছো। এখন থেকে পিছনের গেটেই আমি ডিউটি করমু। আর ডিউটিতো আমি হালায় সবসময়ই ঠিক মতো করি। এই কাল্লু বাঁইচা থাকতে, একটা চামচিকাও গেট দিয়ে ঢুকতেও পারবো না, বাইর হইতেও পারবো না। তোমরা শুধু বাইরের দিকে খেয়াল রাখলেই চলবে। আর একটা কথা মানিক ভাই মোস্তাক ভাই, পুলিশের লোকদেরকে বিশ্বাস কইরা বইসা থাকলে কিন্তু চলবে না। নিজেরাও সতর্কতার সাথে চোখ-কান খোলা রেখে, চারদিকের খবরা-খবর রাখতে হবে।
ঠিক বলেছো কাল্লু ভাই। দু’জনই এক সাথে বলে উঠে। শাহীন তখন খুব সাবধানে খেয়াল করে চিনে নেয় কাল্লু নামের লোকটিকে, যে গেটে ডিউটি করে। আর মানিক-মোস্তাক নাম দু’টিও সে স্মৃতিতে ধারণ করে নেয়।