দুঃসাহসী শাহীন (পর্ব-১২)
॥ কামালের দুঃখের জীবন শুরু ॥
কামালের জন্মের দুই বছর পর তার মা তাছলিমা বেগম দ্বিতীয় বারের মতো গর্ভবতী হন। এরপর এক রাতে তিনি সারা রাত প্রসব বেদনায় কাতরাতে কাতরাতে রাতের শেষ প্রহরে একটি মৃত কন্যাসন্তান প্রসব করেন। তাছলিমার অবস্থাও তখন মুমূর্ষ। সকালে তাছলিমাও চির বিদায় নেন। প্রিয়তমা স্ত্রীর বিয়োগ ব্যথায় আবদুল করিম মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়েন। অবুঝ শিশু কামাল তখন নির্বাক চোখ ঘুরায় – একবার নীরব হয়ে যাওয়া মায়ের দিকে, আরেকবার তার শোকাহত বাবার দিকে। এ দৃশ্য আবদুল করিমের চোখে অসহ্য ঠেকে। তিনি মাতৃহারা শিশু কামালের দৃষ্টি ঘুরিয়ে তাকে বুকের সাথে চেপে ধরে রাখেন অনেকক্ষণ।
প্রিয়তমা স্ত্রীর রেখে যাওয়া শিশু-পুত্র কামালের ভবিষ্যৎ নিয়ে আবদুল করিম মারাত্মক দুর্ভাবনায় পড়ে যান। বাধ্য হয়ে কয়েক মাস পরই তিনি পাশের গ্রামের সানিয়া নামের একটি মেয়েকে বিবাহ করে আনেন। তাছলিমার জমানো অর্ধেক টাকাই খরচ করে ফেলেন বিয়েতে। তাই বিয়ের বর হিসেবে শ্বশুরালয়ে যাওয়ার সময় তিনি মনে মনে বলেন Ñ “হায়রে তাছলিমা, তুই কি শুধু তোর কামালের লেখাপড়ার লাইগ্যাঅই টাকা-পয়সা জমাইছিলি? না কি আমার আরেকটা বিয়ার লাইগাও? ঐ বিবাহের বছরের বর্ষায়ই উম্মত্ত মেঘনার ভাঙ্গনের শিকার হয় তাঁদের ঘর-বাড়ি। প্রমত্ত মেঘনার আগ্রাসী ছোবলে চোখের পলকে তছনছ হয়ে যায়, তাছলিমার মনের মাধুরি মিশিয়ে সাজানো দীর্ঘ দিনের সংসার। হারিয়ে যায় ওদের বাড়ি-ঘর-ফসলি জমি। কোনো রকমে শুধু সরিয়ে রক্ষা করে হালের বলদ দু’টি আর তাছলিমার জমানো কিছু টাকা। সর্বহারা আবদুল করিম তাঁর শিশু-পুত্র কামালকে কোলে করে, গাঁয়ের আরো অনেক মানুষের সাথে দূরে দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকেন, হারিয়ে যাওয়া ঘর-বাড়ির দিকে। সর্বগ্রাসী মেঘনার রাক্ষসী ঢেউয়ের দিকে তাকিয়ে আবদুল করিম চারিদিকে দেখতে পান শুধু আধাঁর – আর আঁধার। সে অনন্ত আধাঁরে তার ভবিষ্যৎ বলতে কিছুই দেখতে পান না। এমতাবস্থায় তিনি তাঁর নববধুর কথায় হালের বলদ দু’টি নিয়ে উঠেন নতুন শ্বশুরালয়ে। সরকারি ত্রাণ হিসেবে কিছু টিন পান আবদুল করিম। সে টিন দিয়ে তাছলিমার জমানো বাকি টাকা খরচ করে ওখানেই আপাতত মাথা গোঁজার ঠাঁই হিসেবে ছোট্ট একটি ঘর তোলেন। লাঙ্গল-জোয়াল তৈরী করেন। এরপর তাঁর শেষ সম্বল – দেহ এবং হালের বলদ দু’টি পুঁজি করে আবারো নতুন উদ্যমে ঝাপিয়ে পড়েন জীবন-সংগ্রামে। স্বপ্ন দেখেন খেয়ে-পরে সঞ্চয়ের। সে সঞ্চয় দিয়ে নিজের একটি আশ্রয় হিসেবে আবারো অন্তত ছোট্ট একটি বাড়ি করার।
আবদুল করিমের নতুন শ্বশুরের নাম আবদুল খালেক। খালেক মাতবর হিসেবে আশে-পাশের দশ গাঁয়ে তিনি পরিচিত। পাঁচ ছেলে আর ছয় মেয়ের জনক আবদুল খালেক একজন সম্পন্ন গৃহস্থ। অনেক জমাজমি তাঁর। নাম-ডাকও বেশ। ফসলও পান প্রচুর। সারা বছর খেয়ে-পরেও অনেক থেকে যায়। অতিরিক্ত ফসল বিক্রির টাকায় প্রতি বছরই একখণ্ড নতুন জমি কিনেন তিনি। জমি কেনা তাঁর একেবারে নেশার মতো। এতো জমাজমির মালিক হওয়ার পরও তাঁর ছেলে-মেয়েরা তেমন লেখাপড়া করেনি। এ নিয়ে তাঁর তেমন কোনো আক্ষেপও নেই। আক্ষেপ হয় শুধু এক খণ্ড জমি হাতছাড়া হয়ে গেলে বা কিনতে না পারলে। আত্মীয়তা করার সময়ও তিনি জমাজমির মালিকই খোঁজেন।
আবদুল করিমের তেমন জমাজমি না থাকলেও তার সাজানো সংসার দেখেই মেয়ে দিয়েছিলেন খালেক মাতবর। এছাড়া সুঠামদেহী আবদুল করিমের ভালো আয়-রোজগার দেখে ভেবেছিলেন, তাঁর নিজের মতো জমি না কিনলেও আবদুল করিমের জমানো টাকা আছে অনেক। ক’মাস পরই তাঁর সে মেয়ের একেবারে এভাবে কপাল ভাঙবে , আর তখন সে জামাই একেবারে নিঃস্ব অবস্থায় তাঁর বাড়িতেই এসে উঠবে ; এমন আশা বা কল্পনা কোনোটাই করেন নি খালেক মাতবর। তিনি আবদুল করিমের বাড়ি হারানোর কারণে যতোটা দু:খ পেয়েছেন, তার চেয়ে বেশি ক্ষুব্ধ হয়েছেন আবদুল করিমের কোনো সঞ্চয় নেই শুনে। তারপরও দুঃসময়ে তাঁর বাড়িতে আশ্রয় নেয়া মেয়ে-জামাইকে বরণ করে নেন খালেক মাতবর।