ধারাবাহিক উপন্যাস “নরক”
পর্ব-১৫
বেলা দুপুর। ভ্যানওয়ালা পরিমল দুইজন যাত্রী নিয়ে একটু আগে বাজারে এসেছে। কাঁদামাটির রাস্তা দিয়ে পাঁচ মাইল পথ ভ্যানগাড়ীর প্যাডেল মেরে এসে পরিশ্রান্ত হয়ে একেবারে হাপশে পড়েছে। সোয়াইতপুর বাজারের পশ্চিম পাশে অবস্থিত বড় তেঁতুল গাছের নিচে তাইতো শরীর এলিয়ে বসেছে আশ্বিনের ঊষ্ণ হাওয়ায়।
ঘর্মাক্ত শরীরে দোল খাওয়া বাতাসটি বেশ মজার ঠেঁকছে। পরিমল মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলো বেশ কিছুক্ষণ বাতাস খেয়ে শরীর জোড়াবে। সেজন্য একজন যাত্রীও ছেড়ে দিয়েছে ইতোমধ্যে। চোখে ঘুম ঘুম ভাব। পরিমল বসে বসে ঝিমোচ্ছে।
পরিমলের বদ্ধ চোখ খোলল গাড়ীর হর্ণ শোনে। চোখ খোলতেই পরিমল রীতিমত থ খেয়ে গেল। পাশেই রাস্তার উপরে চমৎকার একটি প্রাইভেট কার দাড়িয়ে আছে। পরিমল হারমার করে দাড়িয়ে নির্বাক দৃষ্টিতে গাড়ীটির দিকে তাকিয়ে আছে। যেখানে ভ্যান রিকশা চালানো যায় না সেখানে প্রাইভেট কার ! লাল মাটির কাঁচা রাস্তা, সামান্য বৃষ্টি হলেই যেন বমি করে দেয় । গাড়ী তো দূরের কথা হেটে যাওয়াই মুশকিল ।
গাড়ীর ড্রাইভার চেঁচিয়ে প্রশ্ন করল, তালুকদার বাড়িটা কোনদিকে ?
পরিমল তড়িৎ গতিতে কাছে এসে বলল, আপনারা তালুকদার বাড়িতে যাবেন ?
ড্রাইভার বলল, হ।
পরিমল হাতের গামছা দিয়ে মুখ মুছে ফের বলল, সবুজ ডাক্তারদের বাড়িতে যাবেন ?
সঙ্গে সঙ্গে গাড়ীর পেছনের দরজার গ্লাস খুলে গেল। পেছনের সিটে বসে আছে অতিশয় সুন্দরী এক মেয়ে। বয়স কত হবে, পরিমল তা অনুমান করতে ব্যর্থ হল।
গাড়ীর জানালার কাছে মুখ এনে বর্ষা জিজ্ঞাস করল, আপনি সবুজকে চিনেন ?
পরিমল বুঝতে পারছে না মেয়েটি কেন সবুজ ডাক্তারের নাম ধরে বলছে ? পরিমল মুখে কিছু না বলে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানাল।
বর্ষা ফের বলল, কীভাবে চিনেন ?
পরিমল কিঞ্চিত উচ্ছ্বাসিত স্বরেই বলল, ডাক্তার সাহেবকে কে না চিনে ? বিরাট ভালা মানুষ।
পরিমল তালুকদার বাড়ির রাস্তা দেখিয়ে দিলো। সেই রাস্তা ধরে চলে যাচ্ছে বর্ষার গাড়ী।
পরিমল ফের এসে যথাস্থানে বসেছে। তবে এবার তার শরীর জোড়ানোর দিকে খেয়াল নেই। সে ভাবনায় বিভোর হয়ে আছে, একটু আগে গাড়ীতে দেখা মেয়েটিকে নিয়ে। এত সুন্দরী মেয়ে সে তার জীবনে আর কখনও দেখেছে কিনা ইয়াদ করতে পারছে না।
তালুকদার বাড়ি। বর্ষা তার গাড়ীটি ড্রাইভারকে দিয়ে ঢাকায় ফেরত পাঠিয়েছে। সবুজ বাড়িতে নেই। মজনু সবুজকে ডাকতে গিয়েছে। অতিথি সমাদরের কাজটি তাইতো বেগমকে একাই করতে হচ্ছে। বর্ষাকে নাশতা খেতে দিয়ে বেগম তার পাশে দাড়িয়ে আছে।
কয়েক চামচ খাওয়ার পর সেমাইর প্লেট টেবিলে নামিয়ে রেখে বর্ষা বলল, সেমাই তুমি রেধেছ ?
ঘোমটার আঁচলের এক কোণে ধরে মুচকি হেসে বেগম সম্মতি জানাল। বর্ষা কোনো রকম মন্তব্য না করায়, খানিক চুপ থেকে বেগম শুধাল, ভালো হয় নাই ?
টাওয়েল দিয়ে মুখ মুছে বর্ষা বলল, খুব সুন্দর হয়েছে। সেমাই যে এত সুস্বাদু খাদ্য আজই প্রথম জানলাম।
বেগমের চোখে মুখে অনন্দের প্রতিচ্ছবি ফুঁটে উঠল। সামনের চেয়ারে বসতে বসতে বলল, আপনি দেখতে অনেক সুন্দর।
বর্ষা মুচকি হেসে বলল, তুমিও।
আমি তো কালা। লাজুক ভঙ্গিতে বলল বেগম ।
বর্ষা বলল, মানুষের গায়ে তো লেখা থাকে না, সে ভালো না মন্দ । তাই বাহিরের সৌন্দর্যই আসল সৌন্দর্য নয়, আসল সৌন্দর্য মনে। যার মন ভালো তার সব ভালো।
বেগম উন্মোখ হয়ে বর্ষার কথা শোনছে। বর্ষা যত কথা বলছে বেগম তত বেশি অভিভূত হচ্ছে। মনে মনে ভাবছে, এত সুন্দরী একটি মেয়ে, অথচ তার ভেতরে কোনো রকম অহংকার নেই। আমার মত কালা, অশিক্ষিত একটি মেয়ের সাথে কি সুন্দর হেসে হেসে মিষ্টি করে কথা বলছে।
কিছুক্ষণ পর সবুজ ঘরে ঢুকল। সেমাইর থাল নিয়ে বেগম বেরিয়ে গেল। সবুজ বর্ষার সামনের চেয়ারে বসেছে। দুজনেই চুপচাপ বসে আছে। বেশ কিছুক্ষণ অতিবাহিত হয়ে গেল কেউ কোনো কথা বলছে না।
সবুজ নিতান্তই চুপচাপ বসে থাকায় বাধ্য হয়ে প্রথমে বর্ষাকেই মুখ খুলতে হল।
বর্ষা বলল, আমি আসাতে তুমি কি বিব্রত বোধ করছ ?
বর্ষার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসার চেষ্টা করে সবুজ বলল, না, তা হবে কেন ?
সবুজ মুখে না করলেও আসলেই সে চিন্তিত। আর চিন্তার কারণ দুই বছর আগে পাওয়া বর্ষার চিঠি। সেই চিঠিতে বর্ষা লিখেছিল, সে যেদিনই সবুজের সামনে এসে দাড়াবে, সেদিন তাকে বিয়ে করতেই হবে। সবুজ আজ আরেকজনের স্বামী। এই অবস্থায় আরেকটি মেয়েকে কীভাবে বিয়ে করবে সে ?
বর্ষাও দারুন জেদ্দি মেয়ে, একবার যা বলে, সে তা করেই করে। যদি শেষ পর্যন্ত বর্ষাকে বিয়ে করতেই হয় তখন বেগমই কী ভাববে ? এলাকার লোকজনই বা কী বলবে ? বর্ষা এসেছে, এই খবর শোনার পর থেকেই এসব ভেবে সবুজ ভেতরে ভেতরে চাপা অস্বস্তি বোধ করছে।
সবুজকে আবারো নিশ্চুপ হয়ে যেতে দেখে বর্ষা বলল, তুমি কি কোনো কারণে চিন্তিত ?
সবুজ আমতা আমতা করে বলল, না, ঠিক তা না, বাদ দাও। তারপর বলো, কেমন আছ ?
বর্ষা গলা টেনে বলল, ভা-লো।
লন্ডন থেকে কবে ফিরেছ ?
প্রায় একমাস।
তোমার বাবা কেমন আছেন ?
এই প্র্শ্নটি শোনার সাথে সাথে বর্ষার উজ্জ্বল চেহারায় কেমন যেন মলিনতা নেমে এল।
ক্ষণকাল চুপ থেকে বিরস মুখে বলল, বাবার অসুস্থতার কথা শোনেই দেশে এসেছিলাম। কিন্তু এসেও কোনো লাভ হল না। শত চেষ্টা করেও বাবাকে বাঁচাতে পারলাম না।
এই পর্যন্ত বলেই বর্ষা থেমে গেল। ওড়না টেনে চোখ মুছছে। এর আগে বর্ষাকে সবসময় হাসতে দেখেছে সবুজ। এই প্রথম দেখছে কাঁদতে। বর্ষার চোখের জল সবুজের মনের সমস্ত দুশ্চিন্তা ধোয়ে মুছে নিয়ে গেল নিমিষেই। সবকিছু ভুলে গিয়ে বর্ষার দুঃখে নিজেকেও ব্যথিত মনে হল তার।
আদ্র স্বরে জিজ্ঞাস করল, কী হয়ে ছিল ?
বর্ষা কান্না সিক্ত কণ্ঠে বলল, হার্ট এ্যাটাক।
সবুজ আর কোনো প্রশ্ন করল না। নিরবে বেশ কিছুক্ষণ বসে রইল দুজন। এক সময় ধীরে ধীরে বর্ষার চেহারা থেকে কষ্টের নীলাভ কাটতে শুরু করল।
দীর্ঘক্ষণ পর সবুজ বলল, লেখাপড়া কেমন চেলছে ?
শুষ্ক স্বরে বর্ষা বলল, চলছিল কোনো রকম।
লন্ডন আবার কবে যাচ্ছ ?
আর যাব না।
কেন ?
এই কেন শব্দটি শোনার সাথে সাথে বরাবরের মত বর্ষার চেহারায় উজ্জ্বলতা ফিরে এল। মুখে কিছু না বললেও তার ঠোঁটের সাথে চোখ, ভ্রু ও কপোল হেসে উঠল।
সবুজ ফের বলল, ব্যারিষ্টারি পড়ার মুখে ছাই ?
বর্ষা সবুজের দিকে ঝোঁকে এসে বলল, তুমি তো গ্রাম ছেড়ে অন্যত্র থাকবে না। ব্যারিষ্টারি পড়ে লাভ কি ? গ্রামে তো আর কোর্ট কাচারি নেই।
এই কথা শোনার পর সবুজ অন্যদিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলো। খানিক চুপ থেকে অপ্রস্তুত স্বরে বলল, এখনো এসব নিয়ে ভাবো ?
বর্ষা আহ্লাদের সুরে বলল, কেন ভাববো না ?
আমি এখন বিবাহিত, এ কথা জানার পরও ? ফের বলল সবুজ ।
বর্ষা নরম সুরে বলল, তাতে আমার কোনো অসুবিধা নেই। একজন সামর্থবান পুরুষের চার চারটি স্ত্রী থাকতে পারে, তোমার না হয় দুটোই রইল।
সবুজ আর কোনো কথা বলল না। অপ্রসন্ন পায়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। সবুজকে চুপচাপ বেরিয়ে যেতে দেখে বর্ষা চাপা হাসি হাসছে। সবুজের পা ফেলা দেখে সে বুঝতে পারছে, তার এই হঠাৎ আগমনকে সবুজ সহজ ভাবে নিতে পারে নি। সবুজ যখনি কোনো কারণে বিব্রত হয় অথবা অস্বাভাবিক পরিস্থিততে পড়ে তখন তাকে আরো বেশি নিষ্পাপ ও সুন্দর লাগে। আর সবুজের এই নিষ্পাপ ভাবটাই বর্ষার কাছে সবচেয়ে বেশি প্রিয়। সবুজ যখন ঢাকায় থাকত বর্ষা তখন ইচ্ছা করেই মাঝে মাঝে এমন কিছু করত যাতে সবুজের মুখশ্রীতে নিষ্পাপ ভাবটা ফুঁটে উঠে।
(যা না বললেই নয়- এই উপন্যাসের সময় কাল নির্ধারণ করা হয়েছে ১৯৭১ থেকে ১৯৯৩ পর্যন্ত ।)