ঢাকার সিএমএইচ নিয়ে স্মৃতিকথা
(১)
ঢাকায় আমরা চাচার বাসায় থাকি। এই বাসাটা সিএমএইচ এর মসজিদের বিপরীতে। সিএমএইচ এর পুকুর পাড় থেকে আমাদের বাসার আমগাছের কিছু অংশ এখনো দেখা যায়। এই সিএমএইচ নিয়ে কত স্মৃতি জড়িয়ে আছে। এখন সিএমএইচ এর চারদিকে সীমানা প্রাচীর দিয়ে ঘেরা কিন্তু একসময় এই প্রাচীর দিয়ে অবরুদ্ধ ছিল না। যখন তখন আমরা সেখানে চলে যেতাম। বিকালে আমরা সিএমএইচ এর মাঠে খেলতাম। ক্লাস নাইনে থাকতে খরগোশ পালতাম। সেই খরগোশ এর জন্য ঘাস কাটতে প্রতিদিন চলে যেতাম সিএমএইচ এর মাঠে। সেই ঘাস কাটতে গিয়ে একবার আঙুল কেটে ফেলেছিলাম। সেই কাটা দাগ এখনো আছে। সেই কাটা দাগ কেউ দেখতে চাইলে আমার সাথে সাক্ষাতে দেখে নিয়েন। লুৎফর আংকেল নামে একজন পরিচিত আঙ্কেল ছিলেন তিনি সিএমএইচ এ চাকরি করতেন। আমি ছোটবেলায় প্রায় চেষ্টা করতাম ওনার সাথে সিএমএইচ যেতে কারণ তিনি ক্যান্টিন থেকে আমাকে চা খাওয়াতেন। সেই চা এর স্বাদ ছিল অমৃত। দুধের সর ভেসে থাকত। সেই চা আমার এত প্রিয় ছিল যে লুৎফর আঙ্কেল এর জন্য মুখিয়ে থাকতাম আর সুযোগ খুঁজতাম তিনি কখন আমাকে চা খাওয়াবেন। সেই সময় আমাদেরও চায়ের দোকান ছিল। আমি আমাদের দোকানের চায়ের চেয়ে সিএমএইচ এর চা বেশি পছন্দ করতাম। সিএমএইচ এর ক্যান্টিন ছিল আমাদের বাসার পাশেই। ছোটবেলায় আমার একটা প্রধান দায়িত্ব ছিল সিএমএইচ এর ক্যান্টিন থেকে পানি সংগ্রহ করা। তখন ঢাকা শহরে ওয়াসার পানির সাপ্লাই ছিল না। সবার বাসায় নলকূপ ছিল। সেই নলকূপের পানি দিয়ে চা বানালে চা কেন জানি কালচে রং এর হত। আব্বা তাই সিএমএইচ এর ক্যান্টিনের পানি দিয়ে চা বানিয়ে বিক্রি করতেন। আমি যখন পানি আনতে যেতাম কেটলি নিয়ে তখন আমার চোখ থাকত ক্যান্টিনে লুৎফর আঙ্কেলকে দেখা যায় কিনা। লুৎফর আঙ্কেল আমাকে দেখলেই বলতেন- আলামিন আস চা খেয়ে যাও। আমি বিগলিত হাসি দিয়ে চা খাওয়ার জন্য বসে যেতাম। এরপর একসময় লুৎফর আঙ্কেল এর পোস্টিং অন্যত্র হয় আর সিএমএইচ এর চারিদিকে সীমানা প্রাচীর দেবার কারণে অনেক ঘুরে সিএমএইচ এ যেতে হত। সেই চা খাবার বাসনা ধীরে ধীরে কমাতে হল। তবে আজো সেই চা খাবার স্মৃতি চোখে ভাসে।
(২)
আমরা যখন ছোট ছিলাম তখন কাগজের ঘুড়ির দাম ছিল ১ টাকা। কাগজের ঘুড়ি বা পলিথিন দিয়ে বানানো ঘুড়ি আমরা উড়াতাম। সেই ঘুড়ি নিয়ে কাটাকাটি খেলতাম। কোন ঘুড়ি সুতা কেটে ছাপ্পা হয়ে গেলে সেই ছাপ্পা ঘুড়ির পিছনে আমরা ছুটতাম। সেই ১ টাকা দামের ছাপ্পা ঘুড়ি ছিল আমাদের কাছে অনেক দামি। সিএমএইচ এ একটা হেলিপ্যাড এখনো আছে। প্রায়ই এখানে হেলিকপ্টার নামে। ছোটবেলায় দুষ্ট ছেলেদের দেখতামসেই হেলিকপ্টার এর সাথে ঘুড়ি কাটাকাটি খেলার চেষ্টা করত। ঘুড়িকে কোন মতে হেলিকপ্টার এর গায়ে স্পর্শ করাতে পারলেই তারা এটাকে অনেক বড় অর্জন মনে করত। আমি এত ভালো ঘুড়ি উড়াতে পারতাম না। ঘুড়ি নিয়ে আমার ভালো স্মৃতি নেই। যা আছে সেটা হল হেলিকপ্টার নিয়ে। যখন হেলিকপ্টার তার সাঁই সাঁই আওয়াজ করে মাথার উপর দিয়ে যেত তখন যদি আমি ঘরে থাকি সাথে সাথে ঘর থেকে এক দৌড়ে বের হয়ে আসতাম। যখন দেখতাম হেলিকপ্টারটি মাথার খুব কাছেই এর মানে এটি একটু সামনেই নামবে। আমি দৌড়ে সিএমএইচ এর পানে ছুটতাম। আমার সাথে আমার চাচাত ভাই বোনেরা ছুটত। আমার ছোট বোন আয়েশা সে ছোট হবার কারণে ভালো দৌড়াতে পারত না। সেও আমাদের সাথে হেলিকপ্টার দেখবে কিন্তু আমাদের সাথে তালে তালে দৌড়াতে পারত না দেখে মাটিতে গড়িয়ে কান্না জুড়ে দিত। তখন আম্মা বলত- আয়েশাকে নিয়ে যেতে। আমি অগত্যা ছোটবোনকে কোলে নিয়ে দৌড়াতাম। এলাকার সব ছেলে মেয়েরা আমাদের সাথে চলে এসেছে। খুব কাছেই বিশাল বড় একটি যন্ত্র। সেই যন্ত্রের ভেতর থেকে মানুষ বের হচ্ছে আবার মানুষসহ সেই যন্ত্রটি উড়ে যাচ্ছে। এই বিষয়টি আমাদের ছোটবেলায় অনেক অভিভূত করত। আমরা বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে থাকতাম। এখন বয়স পচিশ হয়ে গেছে। এখন আর আগের মত বিস্ময় নিয়ে হেলিকপ্টার এর দিকে তাকাই না আর ছোটবেলার মত সেভাবে দৌড়াই না। তবে কিছুদিন আগে আমার ভাগনি আরাবী আমাদের বাসায় এসেছিল। তখন একটা হেলিকপটার মাথার উপর দিয়ে গেল। একটু পরেই সিএমইএচ এর হেলিপ্যাডে নামবে। আমার ভাগনি সেই হেলিকপ্টার দেখার জন্য ছোটবেলার সেই ছোটবোনের মত মাটিতে গড়াগড়ি দিয়ে কান্না জুড়ে দিল। তখন ভাগনির কান্না থামাতে ভাগনিকে কোলে নিয়ে আমিও দৌড়াচ্ছি আর ছোটবেলার কথা ভাবছি। একসময় বোনকে কোলে নিয়ে দৌড়াতাম তখন আমার এবং বোন দুইজনের চোখেই বিস্ময় ছিল এখন দৌড়াই ভাগনিকে নিয়ে কিন্তু বিস্ময় থাকে শুধু ভাগনির চোখে।
(৩)
আমি আসলেই অনেক সুখি মানুষ। যারা নিজেকে দুঃখী মনে করেন তারা আমার সাথে কোলাকুলি করে আমার সুখের ভাগ নিতে পারেন। কেন বললাম? আমি এই পর্যন্ত ১০ ঘন্টা ব্যতীত কখনো হাসপাতালে ভর্তি হই নাই। রোগ বালাই আল্লাহর রহমতে কম হয়। ২০১১ তে প্রথম হাসপাতালে ভর্তি হই। ডাকসু থেকে খিচুরি খেয়েছিলাম। প্রচন্ড গরম আবহাওয়া ছিল। এই গরম আবহাওয়াতে এই খিচুড়ি পেটে সহ্য হয় নাই। বাড়িতে এসে লাইন সরাসরি হয়ে গেল। খাবার স্যালাইন অনেক প্যাকেট খাবার পরেও কেন জানি কাজ হচ্ছিল না। হাত পা বেঁকে যাচ্ছিল। আমি তো ভয়েই শেষ। এই বুঝি মারা যাচ্ছি। এরপর আইসিডিডিআরবি তে ভর্তি হলাম। পাঁচ ব্যাগ স্যালাইন লাগানোর পর চাঙ্গা হলাম। হাসপাতালে ভর্তি হবার অভিজ্ঞতা ঐটুকুই। তবে রোগী দেখার ভালো অভিজ্ঞতা আছে। আমাদের বাসা সিএমএইচ এর পাশে হবার কারণে অনেক পরিবার আমাদের বাড়িতে ভাড়া থাকত যাদের কোন আত্মীয় দুরারোগ্য কোন ব্যধিতে আক্রান্ত। সিএমএইচ এ তাকে ভর্তি করে তার পরিবারের সদস্যরা সিএমএইচ এর কাছাকাছি কোন বাসায় ভাড়া থাকত। এইরকম অনেক পরিবার আমাদের বাসায় ভাড়া ছিল। যখন ক্লাস ফাইভে পড়ি তখন আমাদের বাড়িতে খালেক নামে এক পরিবার বাসা ভাড়া নেয়। ওনার ভাই ক্যান্সারে আক্রান্ত। আমি ওনাদের সাথে প্রায়ই সিএমএইচে যেতাম ওনার ভাইকে দেখতে। তখন আমি ছোট ছিলাম তাই রোগী দেখতে গেলেই আমাকে সিএমএইচ এর দুধ খেতে দিত। এছাড়াও ফল খেতে দিত। আমিও উৎসাহের সাথে রোগী দেখতে যেতাম। কিন্তু কয়েকমাস বাদেই ওনার ভাই মারা যায়। অনেক কষ্ট পেয়েছিলাম। যার জন্য প্রায়ই ভাত নিয়ে যেতাম। মাঝেমাঝে সেবা শশ্রুষা করতাম তিনি এভাবে চলে গেলেন। পরিবারের কেউ অসুস্থ হলে সেই পরিবারের কত দুর্দিন নেমে আসে তা ঐ পরিবারকে দেখে বুঝে ছিলাম। খালেক ভাইরা চলে যাবার পর আরও অনেক পরিবার আমাদের বাড়িতে এসেছিল। সেই পরিবার নিয়ে অনেক গল্প বলা যাবে। সেদিকে না গিয়ে বর্তমানে আমাদের বাড়িতে যে পরিবার আছে সেই পরিবার সম্পর্কে একটু গল্প বলি। লোকটি নৌবাহিনিতে চাকরি করেন। তার আড়াই বছরের শিশুটি ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত। প্রতিদিন তিনি এবং তার স্ত্রী সকালে সিএমএইচে চলে যান আর আসেন সেই রাতে। রাতে এসে রান্না-বান্না করেন। সারাদিন হাসপাতালে থাকেন। বাড়ির মহিলাদের সাথে যে আন্টি একটু সুখদুঃখের গল্প করবেন সেই সময়টুকু তার নেই। ঈদ আসছে। কেউ নতুন জামা-কাপড় কিনে নাই। কিভাবে কিনবেন? তাদের শিশুপুত্র হাসপাতালের বেডে শুয়ে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছে আর তারা ঈদ করবেন? আসলে ঈদ সবার জন্য নয়। ঈদ মানে খুশি তা সবার জন্য নয়। ঈদের আগমন উপলক্ষ্যে এলাকার ছোট ছেলে মেয়েরা আতশ বাজি ফুটিয়ে আনন্দ করছে। আর ঐ পরিবার সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে সিএমইএচ এর দিকে ছুটছেন। চারদিকের আনন্দ তাদের স্পর্শ করছে না।