ঈশ্বরীয় আবেশ
মহাশূন্যযানের সবাই এই মূহুর্তে কন্টোলরুমের বিশাল স্ক্রীনের সামনে অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে আছে। অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে আছে বললে ভুল বলা হবে। তারা আসলে অবাক বিস্ময়ে খুঁজছে।
‘সিসি আমরা তো কালো অন্ধকার ছাড়া কিছুই দেখছি না। তুমি কি কোন বিশেষত্ব খুজে পেয়েছ? মহাকাশযানের দলপতি পদার্থবিদ কাউরী কেন্দ্রীয় কম্পিউটার সিসি’র কাছে জানতে চান।
‘আপাত দৃষ্টিতে বিশেষত্ব চোখে না পড়লেও মহামান্য কাউরী ইতিমধ্যে আমাদের মহাকাশযানের গতিবেগ শূন্য হয়ে গেছে। আমরা আর সামনে এগুতে পাছি না। কোন একটি বিশাল শক্তি আমাদের বিকর্ষণ করছে।’
পদার্থবিদ লীহা বলে ওঠেন. ‘তাহলে কি রুনের হাইপোথিসিস এর প্রথম অংশ সত্যি প্রমাণিত হতে যাচ্ছে।’
‘প্রচন্ড বিকর্ষণশক্তির জন্য তুমি হুট করেই রায় দিতে পার না যে রুনের হাইপোথিসিস এর প্রথম অংশ সত্যি।’ কোয়ান্টাম মেকানিক্সের অধ্যাপক ত্রিনা বলেন।
‘তোমার কি মনে আছে বছর খানেক আগে আমরা লী ৮০২ গ্যালাক্সীতে এরকম এক প্রচন্ড বিকর্ষনের পাল্লায় পড়েছিলাম। সেটা ছিল ঐ গ্যালাক্সীর কেন্দ্রীভূত আন্তঃশক্তির বিকিরণ।’ অধ্যাপক ত্রিনা পদার্থবিদ লীহার উদ্দেশ্যে বলেন।
‘কিন্তু স্যার আমরাতো এই মূহুর্তে কোন গ্যালাক্সীর ভিতরে নেই। হিসেব অনুযায়ী আমরা মহাবিশ্বের প্রান্তসীমানায় অবস্থান করছি। আর আমরা এসেছি রুনের হাইপোথিসিস এর বাস্তবতা পর্যবেক্ষণ করতে।’ লীহা জবাব দেয়।
দলপতি কাউরী মহাকাশযানের কেন্দ্রীয় কম্পিউটার সিসিকে বলেন, ‘সিসি তুমি যেসব বিদ্যুৎ চুম্বকীয় তরঙ্গ পাঠিয়েছ সেসব কি সামনে যেতে পেরেছে?’
‘হ্যাঁ মহামান্য কাউরী।’
‘তাহলে আমরা পারছি না কেন?’
‘একটা প্রচন্ড শক্তি আমাদের বাঁধা দিচ্ছে। কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার যে আমাদের ধাক্কা দিয়ে পিছনে ফেলে দিচ্ছে না।’
পদার্থবিদ লীহা বলেন, ‘তাহলে আমাদের এখন চার্জ সম্পর্কে নিশ্চিত হতে হবে।’
কেউ কোন কথা বলে না। লীহা বুঝতে পারেন সবার সম্মতি আছে। তিনি সিসিকে বলেন,’ সিসি তুমি কি এইবার টেষ্টক্রাফ্ট দুটো সামনে পাঠাবে?’
রুনের হাইপোথিসিস অনুযায়ী যদি অজ্ঞাত কোন প্রচন্ড বিকর্ষণ শক্তি মহাশূণ্যে আঘাত করে তবে তার ভিতর দিয়ে চার্জ নিরপেক্ষ আধান প্রাবাহিত হতে পারে। আর এই হাইপোথিসিসের উপর ভিত্তি করে দুটো ছোট টেষ্টক্রাফ্ট তৈরী করা হয়েছে যার বহিরাবরণ সম্পূর্ণ চার্জ নিরপেক্ষ আধানের সমন্ময়ে গঠিত।
‘আমি এই মাত্র টেষ্টক্রাফ্ট দুটো সামনের দিকে পাঠিয়েছি’ সিসি উত্তর দেয়।
সবাই অবাক বিস্ময়ে দেখতে থাকে যে চার্জ নিরপেক্ষ মহাশূণ্যযান দুটো সামনে যাচ্ছে। আর কন্টোল প্যানেলের স্ক্রীনে একের পর এক ডাটা ভেসে উঠছে। সবাই খুটিয়ে খুটিয়ে সেটা পড়তে থাকে।
‘রুনের হাইপোথিসিস অনুযায়ী এই মূহুর্তে যে কোন একটি টেষ্টক্রাফ্ট অদৃশ্য হয়ে যাবে।’ দলপতি কাউরী বলেন।
সবাই একদৃষ্টিতে অপেক্ষা করতে থাকে। কিন্তু সেরকম কোন কিছুই ঘটে না। তাকিয়ে থাকতে থাকতে সবাই যখন একেবারে অধৈর্য্য হয়ে ওঠে ঠিক তখনই একটি টেষ্টক্রাফ্ট অদৃশ্য হয়ে যায় আর অন্য একটি প্রচন্ড গতিতে ফিরে আসতে থাকে।
টেষ্টক্রাফ্ট দুটোর বহিরাবরনের ভিতরে একটিতে ছিল ধনাত্মক আধান অপরটিতে ছিল ঋনাত্মক আধানের আধিক্য।
‘কোনটি বিলীন হলো?’ লীহা জিজ্ঞেস করেন।
‘ধনাত্মক, মহামান্য লীহা।’ সিসি উত্তর দেয়।
এবার দলপতি কাউরী বলে চলেন’ তাহলে রুনের হাইপোথিসিসের প্রথম অংশ সত্যি।’
অধ্যাপক ত্রিনাও বলে ওঠেন, ‘অবিশ্বাস্য।’
‘এটাই কি তাহলে মহাবিশ্বেও সীমানার দেয়াল যেটি প্রচন্ড ধনাত্মক আধান দিয়ে তৈরী?’ লীহা বলেন।
কেউ উত্তর দেয় না। সবাই মেনে নেয়।
এবার ত্রিনা নিজেই বলে ওঠেন, ‘আমাদের পরীক্ষানুযায়ী রুনের হাইপোথিসিসের প্রথমাংশ সত্য। প্রাথমাংশ সত্যি হলে দ্বিতীয় ধাপটাও সত্যি হতে পারে।’
‘আমারও মনে হচ্ছে দ্বিতীয় ধাপটাও সত্যি।’ দলপতি কাউরী মন্তব্য করেন।
‘তাহলে টুইন ইউনিভার্স থিওরীটাও সত্যি! দ্বিতীয় ধাপতো দুইটি মহাবিশ্বেকে সমর্থন করে।’ লীহা বলেন।
‘সিসি, এখান থেকে মহাবিশ্বের সীমানা দেয়াল যতটুকু দূরত্ব? যে টেষ্টক্রাফ্ট মানুষ বহনে সক্ষম সেটি নিয়ে কি সমানে যাওয়া সম্ভব? ’ সিসির কাছে দলপতি কাউরী জানতে চান।
‘আমাদের কাছে যতটুকু চার্জ নিরপেক্ষ আধান আছে এতটুকু নিয়ে যেতে পারি। তবে সীমানা দেয়ালের ওপাড়ে কী আছে সে সম্পর্কে আদৌ আমার কাছে কোন তথ্য নেই। আপনারা ফিরতে পারবো কিনা সে সম্পকেও আমি কোন নিশ্চয়তা দিতে পারছি না। ’
‘সিসি তুমি ব্যবস্থা নাও। আমরা যাব এরকম একটা সুযোগ হাজার বছরেও আসে না।’ দলপতি কাউরী সিসিকে নির্দেশ দেন।
২.
ছয় ঘন্টা পরে সবাই টেষ্টক্রাফ্ট করে বের হয়ে সামনের দিকে এসিয়ে যেতে থাকে। একসময় টেষ্টক্রাফ্টটি একেবারে প্রান্তসীমানায় চলে আসে। টেষ্টক্রাফ্টের মনিটরে একটা হালকা দেয়াল ভেসে ওঠে।
‘এটাই তাহলে মহাবিশ্বের বাউন্ডারি।’ লীহা মন্তব্য করে।
সিসি বলে ওঠে, ‘সীমানা দেয়ালের প্রতি ইঞ্চিতে দু’শ ট্রিলিওন ট্রিলিওন কিলোভোল্ট। আমরা হয়তো কোন বিপদ ছাড়াই সীমানা দেয়ালটা অতিক্রম করতে পারব।’
তারপরে হঠাৎ করেই টেষ্টক্রাফ্টটি সীমানা দেয়াল অতিক্রম করে ফেলে। সবার যেন নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল।
‘মহামান্য কাউরী আমরা মহাবিশ্বের বাইরে চলে এসেছি।’ সিসি জানান দেয়।
‘কিন্তু এটা কোথায়?’ বিজ্ঞানী ত্রিনা বলেন। আরও যোগ করেন, ‘এটাই কি সেই ঈশ্বরীয় আবেশের এলাকা?’
কেউ জবাব দেয় না। এমন কি সিসিও না।
‘সিসি তুমি কি এই জায়গাটা স্ক্যানিং করতে পার?’ দলপতি কাউরী জানতে চান।
‘স্ক্যানিং এর অনেককিছুই টেষ্টক্রাফ্টে নাই। তারপরও যতটুকু আছে আমি চেষ্টা করছি।’
সবাই অবাক বিস্ময়ে মনিটরে দেখতে থাকে। হঠাৎ হঠাৎ কিছু একটা ছুটে যেতে থাকে। আলোকচ্ছটার মতো। কিন্তু আলো না।
‘মহামান্য কাউরী আমি কিছু তথ্য যোগাড় করতে পেরেছি। রুনের হাইপোথিসিস অনুযায়ী এটা ঈশ্বরীয় আবেশ হতে পারে। আমি এখানে বিপুল পরিমানে ধনাত্মক আধান দেখতে পাচ্ছি। বিশেষ করে সোডিয়াম, পটাসিয়াম, ক্যালসিয়াম, হাইড্রোজেন। আরও আছে অক্সিজেন আর হিলিয়ামের আধিক্য। মনে হচ্ছে এই মৌলগুলো একটা নির্দিষ্ট চ্যানেলের মধ্যে দিয়ে মহাবিশ্ব দুটোতে সরবরাহ করা হয়। টুইন ইউনিভার্স এর সত্যতা নিশ্চিত হওয়া গেছে।’
সবাই যেন এরকম কিছুই শোনার অপেক্ষায় ছিল।
বিজ্ঞানী ত্রিনা বলেন, ‘তাহলে একই সাথে দুইটা বিগ ব্যাং হয়েছিল আর দুটো মহাবিশ্বের সৃষ্টি হয়েছিল!’
‘রুনের হাইপোথিসিসের তৃতীয় অংশটুকুও সত্যি!’ লীহা বলে।
‘এবার ফেরা যাক।’ দলপতি কাউরী সিসিকে নির্দেশ দেন।
টেষ্টক্রাফ্ট ফিরতি পথ ধরে। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই প্রান্তসীমানা পেড়িয়ে নিজ মহাবিশ্বে ফিরে আসে।
‘সিসি, এবার তুমি মূলমহাকাশযানে প্রবেশ করো।’ দলপতি কাউরী বলেন।
‘মহামান্য কাউরী কোথাও ছোটখাট একটা সমস্যা হয়েছে। আমি মূল মহাকাশযানটি দেখতে পাচ্ছি না।’
কাউরী চমকে ওঠেন, ‘বলো কি? ভালো করে স্ক্যানিং করা।’
‘না মহামান্য কাউরী কোথাও মহাশূন্যযানটি দেখতে পাচ্ছি না। তবে কাছাকাছি কোথাও থেকে হালকা একটা সিগনাল আসছে।’
‘সেটা কিসের?’
‘আমাদের মূল মহাকাশযানের কেন্দ্রীয় ব্ল্যাক বক্সের।’
‘তারমানে মহাকাশযান ধ্বংস হয়ে গেছে? কীভাবে? ’
‘মহামান্য কাউরী, আমি একটা সম্ভাবনা অনুমান করছি।’
‘কি সেটা?’
‘ঈশ্বরীয় আবেশ এলাকা মহাবিশ্বের বাইরে। সেহেতু সেখানে হয়তো সময় পরম স্থির। আমরা যতটুকু সময় ঈশ্বরীয় আবেশের এলাকায় ছিলাম ততক্ষণে এক ট্রিলিয়ন বছর পার হয়ে গেছে। আর সে সময়ই কোন কারণে মহাকাশযান ধ্বংস হয়ে যায়। ব্ল্যাক বক্সটি থেকে যে সিগনাল আসছে সেটি শুরু হয়েছিল এক ট্রিলিয়ন বছর আগে। ব্ল্যাক বক্স এ আমার কিছু স্মৃতি রক্ষিত আছে।’
সবাই হতাশ হয়ে পরে।
ত্রিনা বলেন, ‘তোমার কাছে কি ম্যাপিং আছে। আমরা কি ফিরে যেতে পারব?’
‘মহামান্য ত্রিনা, আমার কাছে ম্যাপিং আছে কিন্তু পর্যাপ্ত জ্বালানী নাই। আমরা কিছুতেই নিজ গ্রহে ফিরে যেতে পারব না।’
লীহা বলেন, ‘আমাদের পরিচিতজনেরা ট্রিলিয়ন বছর আগেই মারা গেছেন। আমার মনে হয় ফিরে না গিয়ে আমরা আবার ঈশ্বরীয় আবেশের এলাকায় যেতে পারি। তারপর চেষ্টা করে দ্বিতীয় মহাবিশ্ব!’
দলপতি কাউরীর দিকে ত্রিনা তাকিয়ে থাকেন। কিছুক্ষন পর দলপতি বলেন, ‘হ্যাঁ, দ্বিতীয় মহাবিশ্বে!’
এর কিছুক্ষন পর ছোট মহাকাশযানটিকে আবার ঈশ্বরীয় আবেশের এলাকার দিকে ছুটে চলে।
লক্ষ্য, এবার দ্বিতীয় মহাবিশ্বে!