প্রিয় প্রহলা
আমাদের বাসার পাশেই একটা বস্তি আছে। বস্তির একটা মেয়ের নাম আঁখি। কিভাবে কিভাবে জানি তার সাথে আমার খুব খাতির হয়ে গেল। আঁখি খুব ভাল একটা মেয়ে।
আমার আব্বু আর আম্মু চাকরি করেন। তাই স্কুল থেকে বাসায় আসার পর আমাকে একা থাকতে হয়। আঁখি চলে আসে বাসায়। সে আমাকে সঙ্গ দেয়। তার সাথে গল্প করি। খেলা করি। তাকে নিয়ে একসাথে দুপুরের খাবার খাই।
ক’দিন যাবৎ আঁখি ঠিক মতো বাসায় আসতে পারছে না। সে নাকি তার মায়ের কাজে সাহায্য করছে। তাই বাসায় আমাকে একা থাকতে হয়। তখন খুব খারাপ লাগে আমার।
একদিন আঁখি আমার জন্যে একটি বিড়াল ছানা নিয়ে এল। সে বলে, ‘সুমাইয়াপু আমি তো প্রতিদিন আসতে পারি না। তাই তোমার জন্য একটা বিড়ালছানা নিয়ে এলাম। এই লও বিড়ালছানা। সে জানে আমি বিড়ালছানা খুব পছন্দ করি। এটা পেয়ে আমি তো খুশিতে নাচানাজি করতে লাগলাম। এখন সে-ই আমার সঙ্গী।
ছানাটি খুবই সুন্দর। ওর গায়ের রং সাদা। সাদার মাঝে আছে কালো গোল গোল দাগ। ছানাটি আমার কোলে বসে পিট পিট করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি তাকে আদর করতে লাগলাম।
আমি ছানাটিকে খাইয়ে দেই। শ্যাম্পো মাখিয়ে গোসল করিয়ে দেই। তার সাথে খেলা করি। রাতে একসাথে ঘুমাই। বিড়ালছানাটি আমাকে ছাড়া কিচ্ছু বুঝে না। আমিও তাকে ছাড়া কিচ্ছু বুঝি না। আমাদের মধ্যে ভীষণ ভাব।
আদরের ছানাটিকে তো আর ‘ছানা‘ ‘ছানা‘ বলে ডাকা যাবে না। ওর একটা সুন্দর নাম রাখা দরকার। মনে মনে সুন্দর একটা নাম খুঁজছিলাম। নিজেই নাম রাখি আবার নিজেই বলি, না এটা না। আবার চিন্তা করতে থাকি। হঠাৎ আমার মুখ দিয়ে ‘প্রহলা’ শব্দটি বেরিয়ে এলো। খুব পছন্দ হয়ে গেল নামটি। আমার বিড়ালছানার নাম রাখলাম ‘প্রহলা‘। আমি ওর কানের কাছে মুখ রেখে ‘প্রহলা‘ ‘প্রহলা‘ বলে ডাকাডাকি করি। প্রথমে সে কিছুই বুঝতে পারত না। খুব বিরক্ত হতো। কিন্তু পরে সে আস্তে আস্তে বুঝতে পেরেছে ওর নাম যে প্রহলা। পরে প্রহলা বলে ডাক দিলে সে যেখানেই থাকে সেখান থেকে লেজ তুলে দৌড়ে চলে আসে আমার কাছে।
আমি প্রতিদিন প্রহলার সাথে কথা বলি। তাকে কথা শিখাই। পড়া শিখাই। খেলা করি। এখন সে আমার অনেক কথাই বুঝে। সে সব সময় আমার সাথে সাথে থাকে। কি যে দুষ্টু হয়েছে ও। পড়তে গেলে সে খাতা, বই, কলম খামচে ধরে কামড়া কামড়ি করে। যখন তখন লাফিয়ে উঠে কোলে। ক¤িপউটারে কাজ করার সময় সে আমার সাথে কী-বোর্ডে টিপাটিপি করে। ধমক দিলে সে-ও ফোঁস করে আমাকে খামচি মারে। মাঝে মাঝে সে রাগ করে। তখন আদর করে চুমু খেয়ে তার রাগ ভাঙ্গাতে হয়। কোনো কিছু নড়ে উঠলেই সে ওৎ পেতে বসে। তারপর লাফ দিয়ে গিয়ে খাবলে ধরে চিবিয়ে খেতে চায়। সুতায় কাগজ বেধে আমি তার সাথে ইঁদুর-বিড়াল খেলি। পাকা শিকারী হয়েছে সে। অসম্ভব মজা করি প্রহলার সাথে। প্রহলা আমার খুব বন্ধু।
স্কুলে যাওয়ার সময় সে খুব বিরক্ত করে। মিঁউ মিঁউ করে কাঁদবে আর পা প্যাঁচিয়ে ধরবে। অনেক কষ্ট করে তাকে রেখে যেতে হয়। স্কুল থেকে আসার সাথে সাথে সে দৌড়ে এসে এক লাফে আমার কোলে উঠে বসবে আর জিহ্বা দিয়ে চেটেচুটে আমাকে আদর করবে। কোল থেকে আর নামতে চায় না সে।
আমরা একজন আরেকজনকে ছাড়া একদম থাকতে পারি না। তার জন্য আমার খুব মায়া হয়।
অনেকেই বলে, সুমাইয়া বিড়ালছানাকে এত আদর করতে নেই। ওর সাথে বেশি মাখামাখি করতে যেও না; ডিপথেরিয়া রোগ হবে। তবুও তাকে আদর করি। কারণ আমি প্রহলাকে ভীষণ ভালবাসি।
গত সপ্তাহে দাদু বাড়ি যাওয়ার সময় প্রহলাকে সাথে করে নিয়ে গেলাম। এ জন্যে কতজনের কত কথা যে শুনতে হয়েছে আমাকে। কেউ বলেছে, ’ও মাইয়া, এইডা কি দেশি না বিদেশি বিলাই গো?’ বললাম এটা দেশি বিড়াল। একজন চোখ বড় করে বলে, `আচ্ছা তোমার বিলাই কি ম্যাজিক দেহাইতে পারে?’ আমি বললাম, `না, না, ম্যাজিক দেখাতে পারে না, তবে রং ঢং করতে পারে। বুঝেছ এবার?’ ওরা বলে, `হ, হ, বুঝছি এইবার, এইডা অইল গিয়া রঙিলা ঢঙিলা বিলাই, নাহ্?’
দাদিবাড়ি বিশাল উঠোন। বাড়ি গিয়ে উঠোনে ছেড়ে দিলাম প্রহলাকে। সে আনন্দে উল্টাপাল্টা ছুটোছুটি করছে। তার দুষ্টুমি দেখে শিশুরা ভিড় করেছে।
আমি হাতমুখ ধুতে কলপাড় গেলাম। হঠাৎ প্রহলার একটা চিৎকার শুনলাম। আমি দৌড়ে এসে দেখি একটা কুকুর প্রহলাকে কামড়ে ধরেছে। আমি চিৎকার করতে করতে একটা লাঠি নিয়ে এসে দেখি কুকুরটি প্রহলাকে শেষ করে ফেলেছে।
আমি মৃত প্রহলাকে কোলে নিয়ে সারাদিন কেঁদেছি।
দাদি আমাকে আরেকটি বিড়ালছানা এনে দিলেন। কিন্তু প্রহলাকে আমি এখনও ভুলতে পারিনি। প্রহলা আমার প্রিয় প্রহলা।