নিয়োগ পত্র (দ্বিতীয় পর্ব)
(তিন)
এ অফিসের দারোয়ানটা নতুন। অবসরপ্রাপ্ত সেনা সদস্য হবে। লম্বা কমপক্ষে সাত ফুটের কাছাকাছি। বুল ওয়ার্ক-এর ব্যাচ। বেশ পাকা পোক্ত শরীর। আঁট সাঁট নীল পোষাক। পায়ে গামবুট। তিমির কাঁচের দরজা পুশ করতেই দারোয়ানের প্রশ্ন – কাকে চান ? বুক পকেটে লাগানো নেম প্লেটে চোখ পরে। নাম বরকতউল্ল্যাহ্।
– মিঃ ঘোষ বাবুকে।
– উনি সীটে নাই। মনে হয় গাড়ী লইয়া বাইর হইছে।
– আপনি জানেন?
– হ।
– কিন্তু আমার যে খুব প্রয়োজন। প্লিজ একবার দেখে আসবেন।
– আইচ্ছা, আপনে এহানে দাঁড়ান। আপনের নামডা কি। ?
– তিমির।
বরকতউল্ল্যাহ ফিরে আসে। তিমিরের চোখে চোক পরতেই যেন লজ্জা পেল। বলল – যান। স্যার আছেন।
– মিথ্যা বললেন কেন ?
– চাকরী বাঁচানোর জন্য বলতে হয়। এক আধটু মিথ্যা বলা ভালো। স্বাস্থ্যের জন্য বড়ই উপকারী। কিছু মনে কইরেন না।
– না না, এমনি বলছিলাম। কবে আসছেন ?
– গত হপ্তায়।
– এবার যায়।
বরকত নিজের হাতে দরজাটা খুলে দেয়। ভিতরে পা দিতেই দরজা নিজে থেকে বন্ধ হয়ে গেলো। লোকাল বাসের যন্ত্রনাদায়ক ক্লান্তিটা যেন মূহুর্তেই উবে গেলো। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বড় অফিস। চারিদিকে থাই গ্লাসের আউট ফিটিংস। ছিমছাম নীরবতা। কর্মীরা যে যার কাজে ব্যস্ত। নীরবতা ছেদ করে বেজে উঠে একের পর এক টেলিফোন। ক্রিং—ক্রিং—ক্রিং—।
ঘোষ বাবু রিসিভার তুলে নেয়। হ্যাঁলো—-হ্যাঁ—ঘোষ বলছি—নো — নো—-কালই শিপমেন্ট হবে—হ্যাঁ—-হ্যাঁ—ছয় নম্বর জেটিতে। হ্যাঁ— হ্যাঁ—ও কে—এ্যাঁ—না না। ঠিক আছে। রাখছি।
আবার টেলিফোন। ঘোষ বাবু রিসিভার তুলে নেয়। একটা রিসিভার কাঁধে চেপে ধরে ডান হাতে মাউথ পীস চেপে ধরে। বাম হাতে রাখা রিসিভারে কথা বলে—হ্যালো—ও আচ্ছা–না..না আসলে কাজের চাপে ভূলেই গিয়েছিলাম। এখনিই পাঠাচ্ছি। কি করবো বলো–আচ্ছা ঠিক আছে। রাখি।
তিমির সামনে দাঁড়াতেই হাতের ইশারায় বসতে বললেন। কাঁধে চাপা রিসিভারে কিছু জরূরী কথা সেড়ে রিসিভার রেখে দেন ঘোষ বাবু।
ঘোষ বাবু ভীষন ব্যাস্ত মানুষ। মোটা অংকের মাইনে। এত ব্যস্ততার মাঝেও তিমিরের জন্য যথেষ্ট সময় দেন। অন্যান্য অফিসে নিজেই তদবীর করেন। চাকরী হলেও ঘোষ বাবুর ঋণ কোনদিন শোধ হবার নয়। একটা কাজ পেলে ব্যস্ত জীবনটা আরও সুন্দর হতো। তিমির একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। চাকরীটা বুঝি আর হলো না।
– মোক্তার। ঘোষ বাবু ডাকলেন।
– জ্বী স্যার।
– দু’কাপ চা। আর এই কাগজটা সবিতাকে দিয়ে বলো, এক্ষনি টাইপ করে দিতে।
– জ্বী স্যার।
এবার তিমিরের দিকে তাকিয়ে বলল-তোমার খবর কি বলো।
– ভালো।
– শুনলাম গ্রামে নাকি চুরি, ডাকাতি বেড়ে গেছে। মদ, গাঁজার ব্যবসাটাও নাকি খুব জমজমাট।
– ঠিকই শুনেছেন।
– এসব বন্ধ করা যায় না ?
– না।
– কেন ?
– কেন-র কোন জবাব নেই। প্রশাসনকে ম্যানেজ না করে কেউ তো এ-কাজ করতে পারে না। কেউ বাঁধা দিতে গেলে থাকে মামলায় ফাঁসিয়ে দেবে। কে যাবে অত ঝামেলায়। ওদের হাত অনেক লম্বা।
– কি বলছ এসব।
– ঠিকই বলছি। গ্রামে তো থাকেন না। গেলেও সকালে গিয়ে বিকালে আসেন। সন্ধ্যার আসল চেহারাতো দেখা হয় না।
– তোমরা কিছু করছো না কেন।
– আমরা বেকার, তাই। আমরা প্রতিবাদ করলে ফল হবে উল্টো। বেশীক্ষন ঠিকে থাকতে পারবো না। আর যারা শালিস বিচার করবে তাদের দু’প্যাগ ফ্রি দিলেই দিন হয় রাত আর রাত হবে দিন। আমাদের গ্রামের লুলা অধীর। যে মদ বিক্রি করে। তারও এখন অনেক ক্ষমতা। অনেক খ্যাতি। দারোগা এসে আগে অধীরকে তলব করে। সবাই সমীহ করে কথা বলে। মাঝে মাঝে ইচ্ছা হয়.. তিমির থামে। ঘোষ বাবু জিজ্ঞাসা করে-
– কি করতে চাও ?
– না। কি আর করব। একটা কাজে থাকলে আত্মবিশ্বাসটা বাড়ে। এদিকে অন্য একটা কাজে আসছিলাম। ভাবলাম আপনার সাথে একটু দেখা করে যায়।
মোক্তার চা দিয়ে গেল। চায়ে চুমুক দিতেই টেলিফোন। হ্যাঁলো–ঘোষ স্পীকিং। নো নো–হংকং—ইয়েস—থার্টি ফাইভ থাউজেন্ড ডলার… উইদিন দ্যা নেক্সট মানথ্ ..ওকে। রিসিভার রেখে ঘোষ বাবু দুঃখ করে বললেন-
– বুঝলে চাকরী বাকরী আর ভালো লাগছে না। মাঝে মাঝে ইচ্ছা হয় গ্রামে চলে যায়। প্রতিদিন বিকেলটা মন্দিরের ঘাটে গিয়ে বসি। গ্রামে ছোঠ খাটো একটা কাজের মধ্যে লেগে থাকি। হাসি আনন্দে জীবনটা কাটায়।
চায়ের কাপটা রেখে বলল তিমির-
– পারবেন না। এখন শহরে আছেন দেখে গ্রামের স্বপ্নটা ভালো লাগছে। বেশীদিন থাকলে ভালো লাগবে না। সহ্য করতে পারবেন না।
– তা অবশ্য ঠিকই বলেছো।
– গ্রামের জীবনটা অত সহজ নয়। খুব কঠীন। ওখানে নিয়মিত থাকলে আপনার পরিষ্কার পোষাকে কাঁদা ছিটানোর লোকের অভাব হবে না। তার চেয়ে এই ভালো আছেন শহরে। মাঝে মধ্যে গ্রামে যাবেন। গ্রামের বোকা সোকা মানুষগুলোকে কয়েকটা উপদেশ দিয়ে ফিরে আসবেন। তাতেও মন্দ ভালো বিচারের ভারটা গ্রামের মানুষরা চিন্তা করবে।
তিমিরের হাতে হলুদ খামটার দিকে চোখ পড়ে ঘোষ বাবুর। জিজ্ঞাসা করে
– -ওটা কি।
– জি, এম ট্রেডিং-এ কমার্শিয়াল-এ একজন লোক নিচ্ছে। এপ্লিকেশনটা রেডি করে এনেছি।
– আসলে তোমার ভাগ্যটায় খারাপ। কত লোককে বললাম। কিন্তু কিছুই করতে পারছি না। তোমার জন্য খুব চিন্তা হয়।
– মামা, আমি যে মকর রাশির জাতক। সব কিছু হাতের কাছে পেয়েও শেষ পর্যন্ত কিছুই পাওয়া হয় না। তিমির বলতে চাইল, মামা আমি যে আপনার কাছে অনেক বেশী কৃতজ্ঞ। কিন্তু বলতে পারল না।
– ভালো কথা মনে করেছো। কোন জ্যেতিষীকে দিয়ে তোমার ভাগ্যটা একবার পরীক্ষা করিয়ে দেখতো। অনেক সময় গ্রহ খারাপ হলে এমনটি হয়।
তিমির হাসি চেপে বলল
– -তাই করব মামা।
– আর ওখানে তোমার এপ্লিকেশনটা জমা দিয়ে দাও। আমি খোঁজ নিয়ে দেখব পরিচিত কাউকে পাওয়া যায় কি না।
– মামা একটা কথা বলবো ?
– কি ?
– আসলে বার বার এসে আপনাকে বিরক্ত করতে ইচ্ছা করে না। কিন্তু কি করব। আমি জানি আপনি আমার জন্য অনেক চেষ্টা করেন। কিন্তু চাকরী হয় না। এতে আমার চেয়েও আপনার কষ্ট বেশী।
– সত্যি বলতে কি। তুমি আসলে আমি নিজেও লজ্জা বোধ করি। তোমাকে একটা কাজ দিতে পারলে আমি নিশ্চিন্ত হতে পারতাম।
তিমিরের পা পরে আবার শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষের বাইরে। উত্তপ্ত রাজ পথ। রোদের কণাগুলো যেন সুচের মত বিধঁছে শরীরে। লক্ষ্য একটায়। হলুদ খামটার সদ্ব্যাবহার করা।
চলবে…….