Today 11 Oct 2025
Top today
Welcome to cholontika

দিগম্বর

: | : ০৩/০৯/২০১৩

আমাদের পাশের গ্রামের নাম আছিম। ঐ গ্রামে অনেক বড় একটি বাজার আছে । গ্রামের নামেই বাজারের নাম, আছিম বাজার। আমাদের উপজেলায় অবস্থিত সবচেয়ে বড় বাজার এটি । সপ্তাহে দুইদিন,শনিও মঙ্গলবার হাট বসে এখানে। হাটে গবাদি পশু থেকে শুরু করে প্রায় সব কিছুই পাওয়া যায় । এই বাজারে হঠাত এক দিগম্বর পাগলের আবির্ভাব হল। যে কিনা কারো সঙ্গে কোনো প্রকার কথাবার্তা বলে না। আমাদের সমাজের পাগলরা হেলা ও বঞ্চনা পাত্র হলেও,পাগলদের অনেকে কামেল(আউলিয়া,দরবেশ) লোক হয় বলে,কারো কারো মনে এ রকম সুপ্ত সন্দেহও আছে।

অনেকে চোখলজ্জায় পড়ে,আবার কেউ কেউ লালসায় ডোবে সেই দিগম্বর পাগলকে লুঙ্গি জামা কিনে দিলো,কিন্তু পাগল সেগুলো পরিধান করা তো দূরের কথা হাত দিয়ে ছোঁয়ও নি। ঐ বাজারের পাশেই আমাদের কলেজ। আমাদেরকে বাজারের উপর দিয়ে কলেজে যাওয়া আসা করতে হয়। কলেজে যাওয়া আসার ফাঁকে অনেকবার আমি ঐ পাগলকে দেখেছি। লম্বা, শীর্ণকায় দেহ,মাথায় লম্বা চুল,ময়লা জমে যট বেঁধে গেছে চুলে। দেখতে দেখতে হঠাত করেই নিখোঁজ সেই পাগল। কোথায় গেল?খোঁজে দেখা তো দূরের কথা,কারো কোনো প্রকার ভাবান্তরও হল না।

আমাদের প্রতিবেশি সোলায়মান আলি,আমি যাকে চাচা বলে ডাকতাম। সোলায়মান চাচা কাপড়ের দোকান করেন। ভাসমান কাপড়ের দোকান। পুটলা বেঁধে বাজারে বাজারে কাপড় নিয়ে যান,বিক্রি শেষে যা বাচে পুটলা বেঁধে সেগুলো ফেরত নিয়ে বাড়ি চলে আসেন। সোলায়মান চাচা আমাকে অনেক স্নেহ করতেন। কেন করতেন,ঠিক বলতে পারব না। আমাকে শুধু একা নয়, ছোটদের প্রতি তার এক ধরনের বিশেষ মায়ার টান ছিল বলা যায়। একদিন সকালে হঠাত করেই শোনতে পেলাম আমাদের সেই সোলায়মান চাচা পাগল হয়ে গেছেন। দৌড়ে গেলাম দেখতে,কিন্তু দেখা পেলাম না। জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম,তিনি নাকি বিবস্ত্র হয়ে বাজারে বাজারে ঘুরে বাড়াচ্ছেন,বাড়িতে আসেন না। কথাটি ঠিক বিশ্বাস হচ্ছিল না। তার কয়েকদিন পরেই একদিন কলেজে যাবার সময় আছিম বাজারে সোলায়মান চাচাকে উলঙ্গাবস্থায় দেখলাম! ওনাকে এই অবস্থায় দেখে প্রথমে ইচ্ছে করছিল,এক দৌড়ে কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করি,এমন করছেন কেন ? কিন্তু লজ্জা আর ভয়ে যাওয়া হয় নি। সোলায়মান চাচা আমাকে দেখে দূরে দাড়িয়ে মুচকি হাসলেন।

প্রায় বছর খানিক পর। বাড়িতে শোনতে পেলাম সোলায়মান চাচা খুবই অসুস্থ,আমাকে দেখতে চায়। আমি গেলাম সোলায়মান চাচার বাড়িতে। কাচারীঘরে খেজুরপাতার পাটিতে তিনি একাকী শুয়ে আছেন,দূর থেকে ঠিক কঙ্কালের মতো দেখাচ্ছিল। আমি কাছে যেতেই সেলায়মান চাচা বললেন, মিনু বসো।

আমি তার পাশে পাটিতে বসলাম। অনেক কথাই হল আমাদের। অত্যন্ত স্পষ্ট ছিল তার কন্ঠস্বর। কথা শোনে মোটেও বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল না, এই লোকটি পাগল ছিল,প্রায় বছর খানেক উলঙ্গ হয়ে বাজারে বাজারে ঘুরে বেড়িয়েছে। সোলায়মান চাচা পাগল হবার পর তার স্ত্রীকে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। দুই ছেলেমেয়েকে নিয়ে অর্ধহার অনাহারেও দিনে কেটেছে। জমিজমা তেমন নেই,সোলায়মান চাচাই ছিলেন সংসারের একমাত্র কান্ডারী । সেই কান্ডারী যখন ভবঘুরে হয়ে গেল,তখন সংসার লাটে ওঠার যো হল। মহিলা হয়ে পুরুষের ন্যায় সংসার কর্মে মনোনিবেশ করলেন,সোলেমান চাচার স্ত্রী।

সোলায়মান চাচার সঙ্গে কথাবার্তার এক ফাঁকে আমি বললাম,কয়েকদিন আগেও যে আপনি পাগল ছিলেন,আপনার কথাবার্তা শোনে কিন্তু তা মনে হচ্ছে না।

সোলায়মান চাচা লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে বললেন,আরে বাবা, পাগল আর হইতে পারলাম কই?পাগল হইতে পারলে কি আর এই জিন্নতের মরন মরতে হইতো?

আমি বললাম,  আপনি পাগল হন নাই?

না।

তাহলে বাজারে বাজারে উলঙ্গ হয়ে ঘুরে বেড়িয়েছেন কেন?

ওসব সাধানর বিষয়,তুমি বুঝবে না। বিড়বিড় করে বললেন সোলায়মান চাচা।

আমি বললাম,বুঝিয়ে বললেই বুঝতে পারব।

সোলায়মান চাচা তারপর যা বললেন তা শুনে আমার তো আক্কেলগুড়ুম অবস্থা। সেদিন শনিবার ছিল। সোলায়মান চাচা যথারীতি আছিম বাজারে কাপড়ের দোকান খুলে বসেছেন। আসরের আগে আগে বাজারের অবস্থানকারী দিগম্বর পাগল সোলায়মান চাচার দোকানে এসে একটি গামছা দিতে বলে। এই পাগল যে কখনো পোশাক পরিধান করে না,সোলায়মান চাচা এটা ভালো করেই জানতেন। ক্ষণকাল বিলম্ব না করে চাচা পাগলের হাতে একটি গামছা দিলেন। পাগল গামছা দিয়ে তার লজ্জাস্থান ঢেকে পশ্চিম দিকে রওনা হল। আকস্মিক পাগলের আচরণগত পরিবর্তন দেখে সোলায়মান চাচার মনে প্রশ্ন জাগে,যে পাগলকে কখনো জোর করেও কাপড় পরানো যায় নি। সে আজ স্বেচ্ছায় কাপড় পরেছে! কেন?

এই কেন-র উত্তর খোঁজতে দোকান বন্ধ করে সোলায়মান চাচা পাগলের পিছু নিলো। বাজারের পশ্চিম দিকের শেষ প্রান্তে ছোট্ট একটি ব্রীজ আছে। পাগল সেই ব্রীজ পার হয়ে দাড়িয়ে আছে। চাচা তাকে দূর থেকে লক্ষ্য করছেন। বেশ কিছুক্ষণ পর পশ্চিম দিক থেকে একজন লোক এসে বাজারে ঢুকল, এবং পাগল তাকে সালাম দিলো। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই সেই লোকটি বাজারের ভিড়ের মাঝে হারিয়ে গেল। লোকটি চলে যাওয়া মাত্রই পাগল ফের বিবস্ত্র হয়ে গেল। পাগলকে পুনঃরায় বিবস্ত্র হতে দেখে সোলায়মান চাচা দৌড়ে পাগলের কাছে গেল এবং জিজ্ঞেস করল,আজ হঠাত কেন তিনি কাপড় পরেছেন ?

পাগল বলল,কাপড় পরার প্রয়োজন পরে না বলেই পরি না।

সোলায়মান চাচা স্তম্ভিত স্বরে বললেন,বাজারে এত মানুষজনের সামনে আপনি ল্যাংটা হয়ে ঘুরে বেড়ান,আপনার লজ্জা করে না?

খানিক চুপ থেকে পালগ বলল,আমার দুই পা-এর ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে দেখ,বাজারে মানুষ আছে কয়টা?

অগত্যা ঘাড় ঋজু করে সোলায়মান চাচা পাগলের দুই পা-এর ফাঁক দিয়ে বাজারের দিকে তাকালেন এবং হতবিহ্বল হলেন। প্রথম দৃষ্টিতে যা দেখলেন তা বিশ্বাস করতে পারলেন না। চোখ মুছে দ্বিতীয় বার তাকানোর পর একই জিনিস দেখলেন। তিনি সোজা হয়ে হা করে পাগলের মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন। কিছুক্ষণ পর পাগল জিজ্ঞেস করল,কী দেখলি ? বাজারে মানুষ আছে?

সোলায়মান চাচা মাথা নাড়িয়ে না করার পর পাগল আবার জিজ্ঞেস করল, কী আছে?

সোলায়মান চাচা বললেন,বাজার ভর্তি কুকুরে!

পাগল বলল,কুকুরের সামনে মানুষের লজ্জার কি আছে,কুকুরের সামনে আমাকে কাপড় পরতে হবে কেন?

সোলায়মান চাচা এই প্রশ্নের উত্তর দিলেন না । কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর জিজ্ঞেস করলেন,তাহলে আজ কেন কাপড় পরে ছিলেন?

পাগল বলল,একটু আগে যে লোকটি বাজারে ঢুকলেন,তিনি একজন মানুষ ছিলেন। মানুষের সামনে তো উলঙ্গ থাকা যায় না।

সোলায়মান চাচা বললেন,তাহলে ঐ লোকটি এখন কোথায় ?

পাগল বলল,ভালো করে আবার তাকিয়ে দেখ।

সোলায়মান চাচ ফের পাগলের দুই পা-এর ফাঁক দিয়ে বাজারের দিকে তাকালেন । অগুনিত রঙ বেরঙের কুকুর বাজারে ঘেউ ঘেউ করছে। অনেক দূরে একজন লোককে আবছা দেখা যাচ্ছে। সোলায়মান চাচা আর সোজা হলেন না। দুই হাতে পাগলের পা চেপে ধরে কান্নাকাটি করতে করতে পাগলকে একটা কিছু দিতে বললেন।

পাগল বলল,আমি অতি সামান্য একজন মানুষ,কাউকে কিছু দেবার মতো ক্ষমতা আমার নেই। একটু আগে যে লোকটি বাজারে ঢুকল,তার কাছে চাইলে হয়ত কিছু পেতেও পারতিস।

সোলায়মান চাচা সঙ্গে সঙ্গে পাগলের পা ছেড়ে দিয়ে বাজারের দিকে উন্মাদের ন্যায় দৌড়াতে লাগলেন। ভিড় ভেঙ্গে দৌড়াতে গিয়ে কখন যে তার পরনের লুঙ্গি খুলে গিয়েছে নিজেও জানেন না। তারপর সোলায়মান চাচা আর কাপড় পরেন নি। এবং সেই দিনের পর সেই দিগম্বর পাগলকে আর কোথাও কেউ দেখে নি।

সোলায়মান চাচা এসব কথা যেদিন আমাকে বললেন তার তিন দিন পর তিনি মারা যান । সোলায়মান চাচার মুখে শোনা সেই গল্প এখনো আমার মনে দাগ কেটে আছে। আজ প্রায় এক যুগ হতে চলল সোলায়মান চাচা মারা গেছেন আথচ আমি আজও আনমনে লোকালয়ে নির্জনে খোঁজে ফেরি সেই দিগম্বর পাগলকে।

 

(সত্য ঘটনা অবলম্বনে)

লেখক সম্পর্কে জানুন |
সর্বমোট পোস্ট: ০ টি
সর্বমোট মন্তব্য: ১ টি
নিবন্ধন করেছেন: মিনিটে

মন্তব্য করুন

go_top