ধারাবাহিক উপন্যাস “নিয়োগ পত্র” পঞ্চম পর্ব
৫ম পর্ব
(ছয়)
স্যার কাল আসেননি কেন।
শেলী যেন কৈফিয়ত চাইছে। ও এরকমই। সহজ সরল কথা বলার ভঙ্গি। প্রাণের ছোঁয়া লেগে থাকে। আন্তরিকতায় পরিপূর্ণ। কৈফিয়ত চাওয়াটা যেন ওর অধিকার। হালকা অভিমান লুকিয়ে থাকে কোথাও। বুঝা যায় না। এরকম প্রশ্ন ভালো লাগে। রাগ করা যায় না।
– কাজ ছিল। তিমির সোফায় বসে বলল।
– আমার রেজাল্ট শুনে আপনি খুশী হননি।
– অবশ্যই। তার জন্য কনগ্রেচুলেশন জানাতে এলাম। থ্যাঙ্কস্ ফর ইউর সাকসেস।
– থ্যাঙ্ক ইউ স্যার। কি খাবেন বলুন।
– এক কাপ চা হলেই চলবে।
শেলী কাজের বুয়াকে ডেকে চা দিতে বলে।
– কাকীমাকে দেখছি না।
– মা বাসায় নেয়। মিটিং আছে।
– দেবু কোথায়।
– বাইরে কোথাও খেলছে মনে হয়।
– এডমিশন কোথায় নেবে ভাবছো।
– এখনও ভাবিনি। আপনিই বলুন।
– ভালো কোন সরকারী কলেজে চেষ্টা করতে পারো। আজ উঠি।
শেলীকে আজ খুব উৎফুল্ল মনে হচ্ছে। সকাল থেকে ভেবেছে স্যার আসলে আজ অনেক সময় নিয়ে গল্প করবে। শুধু গল্প। কোন লেখাপড়া নেয়। অন্য কথা সব। বইয়ের পাতার বাইরের কথা। যা কারও সামনে বলতে পারে না। একাকী বলতে পারলে ভালো হয়।
তিমির ক’দিন ধরে লক্ষ্য করেছে যে, শেলীর কথাবার্তার মধ্যে একধরনের লুকোচুরি খেলা করছে। যা ছাত্র শিক্ষকের সম্পর্কের বাইরের কিছু একটা মনে হয়। টিচারের কাজ থেকে শেলীর কাজ কিছু বুঝে নেওয়া। এর বাইরে শেলী নিজেও স্যারকে কিছু বোঝাতে চায়। কথায় নয়, কাজে। আকারে ইঙ্গিতে। দু’টি মায়াবী চোখের ভাষায়। তিমির বুঝেও না বুঝার মত ভান করে। টিউশানি তাকে করতে হবে। নয়তো চলবে কি করে। আজকাল টিউশানি পাওয়াও মুশকিল। চাকরির বাজারের মত হয়ে যাচ্ছে। সেখানেও অভিজ্ঞতা চায়। রীতিমত ইন্টারভিউ নিয়ে প্রাইভেট টিউটর রাখে। অদূর ভবিষ্যতে প্রাইভেট টিউটরদের জন্য ইন্টারভিউ বোর্ড বসবে। এপয়েন্টমেন্ট লেটার দেবে। তাতে আশ্চার্য হবার কিছু থাকবে না।
সন্ধ্যেটা খুবই চমৎকার।
শহরের ঝলমলে আলোর মাঝেও কুয়াশার চাদর জড়িয়ে আছে। নিঃশ্বাসে মন ভরে যায়। মন পাগল করা একটা গন্ধ। দিনের প্রান চাঞ্চল্য খুব একটা থাকে না। শুধু ঘরমুখো মানুষগুলোর ঘরে ফেরার ব্যস্ততা। কুয়াশার চাদরে কেমন একটা নেতিয়ে পরা ভাব। শহরের কোলে এখনও ঠান্ডা বলতে যা বোঝায় তা শুরু হয়নি। গ্রামে তার বিপরীত। প্রচন্ড ঠান্ডা। এরই মধ্যে স্যাঁত সকালে নাড়ার আগুন পোড়ানো শুরু হয়েছে।
শীত শুরু হলো বলে মাকে কতদিন বলেছে মোটা কাঁথা আর কম্বলটায় একটু তালি জোড়া লাগিয়ে দেওয়ার জন্য। এবার শীতটা হঠাৎ করে ঝেঁকে বসেছে। মা দেবো দিচ্ছি করে করে আর সময় হয়নি। কাঁথার ভিতর আগুনের পাতিলটা বাবার প্রতি রাতের নিত্য সঙ্গী। মা তুষের আগুন দিয়ে সেটা জ্বালিয়ে রাখে। তুষের আগুন দীর্ঘ সময় তাপ দেয়। ধীরে ধীরে জ্বলে। অন্তর জ্বালার মত। বাইরে থেকে বোঝা যায় না। শুধু ভিতরে ভিতরে নীরবে ক্ষয় হতে থাকে। ডি সি হিলের পাশ দিয়ে ফুটপাত বরাবর হাটতে হাটতে কথাগুলো তিমিরের মনে পরে। একটা ভয়ও হয়। মা কতবার বারন করেছে। রাতের বেলা আগুনের পাতিল নিয়ে না শোওয়ার জন্য।
জগদীশ বাবু কিছুতেই শোনেন না। বলেন-
– এখন বয়স হয়েছে। শরীরের রক্তগুলো পানি হয়ে গেছে। আগুনের তাপ না হলে শরীরে উম না। একটা নাতী নাতনী থাকলে অন্তত: বুকে নিয়ে উম নিতে পারতাম। মা স্বপ্ন দেখে ছেলেটার একটা চাকরী হতো তাহলে বিয়ে দিয়ে নাতী নাতনী ঘরে আনতো। জগদীশ বাবুর কথার রেশ ধরে মহামায়া বলে-নাতী নাতনী করে করে দেখো ঘরে আবার আগুন দিয়ে বসো না।
তার ক’দিন পরেই ঘটনাটি ঘটলো।
সেদিন প্রচন্ড হাঁড় কাঁপানো শীত। দু’একদিন গুড়ি গুড়ি বৃষ্টিও হয়েছিল। তাতে সবার ধারনা এবার শীতটা আরও বেশী পরবে। খাওয়ার পর জগদীশ বাবু আগুনের হাড়িটা নিয়ে শুয়েছিল বারান্দায়। জীর্ণ শীর্ণ শরীর। রক্ত মাংস বলতে কিছুই নেয়।সাপের খোলস পাল্টানোর মতো করেই শরীরের ফ্যাঁস ফ্যাঁসে চামড়াগুলো উঠে যাচ্ছে। পাতলা চামড়ার বেষ্টনী দিয়ে কোন রকমে রক্ষা করছে হাড়গুলোকে।
দু’টো হাঁটুকে ছোট পাহাড়ের ঢিবির মত করে কাঁথামুড়ি দিয়ে শুয়েছিল জগদীশ বাবু। কাৎ হয়ে গুটিশুটি হয়ে শুতেই আগুনের হাড়িটা ঢলে পড়েছিল বিছানায়। জগদীশ বাবু খেয়াল করেনি। উমটা ভালোই লাগছিল। যখন খেয়াল হল তখন ডান পায়ের গোঁড়ালিটা অনেকটা ঝলসে গেছে। সারা ঘর ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন। চিৎকার করে বলতে পেরেছিল আগুন—আ—গু—ন।
মহামায়া ঘুম ঘুম চোখে দৌড়ে এসে প্রথমে কিছুই বুঝতে পারেনি। তেলের কুপি জ্বালাল। দেখল সারা ঘর অন্ধকার। কলসী শুদ্ধ জল বিছানায় ঢেলে দিল। জগদীশ বাবু তখনও অজ্ঞান। সে যাত্রায় রক্ষা পেয়েছিল মানুষটা। ঘরটাও বেঁচে গেলো। তবে জগদীশ বাবুর সেই ক্ষতটা শুকাতে অনেক সময় লেগেছিল।
সেবার টিউশনির টাকা থেকে তিমির বাবার জন্য একটা মোটা উলের সোয়েটার কিনেছিল। দাম বেশী নয়। নিক্সন মার্কেট থেকে কেনা। ইচ্ছে ছিল আর একটু বেশী দাম দিয়ে কেনার। কিন্তু সামর্থ ছিল না। সেই সাথে একটা মাথার টুপি ও এক জোড়া উলের মৌজা। বাবা খুশী হয়ে বলেছিল ভালোই হয়েছে। এবার শীতটা একটু কম লাগবে। আর জিনিষটাও ভালো। বেশ গরম আছে। মোটা উল। দাম কত নিল। নিশ্চয় বেশী দাম দিয়ে ভলো জিনিষ কিনেছিস।
বাবার আরও কত কথা।
কি দরকার ছিল এত দাম দিয়ে জিনিষ কেনার। আমি বলি কি, আজকাল টাকা ছাড়া যখন চাকরী বাকরী হয়না, তখন কিছু কিছু টাকা জমা কর। টাকা দিয়ে যদি একটা ভালো চাকরীর খবর পাস, তবে না হয় গাই গরুটাও বেঁচে দেবো। তারপর একটা দীঘশ্বাস ছেড়ে বলল- আসলে আমাদের ভাগ্যটায় খারাপ। নয়তো এত মানুষের চাকরী হয়, আমার ছেলের হয় না কেন।
জগদীশ বাবুর কথায় পষ্ট অভিযোগ। এ যেন তার পাওনা ছিল। অথচ অদৃশ্য কারনে যেন সে পাওনা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
বঞ্চিতের হতাশায় কেবলই শ্রষ্টাকে রোষানলে পরতে হয়। শ্রষ্টা নামক ব্যাক্তিটি যেন এ ব্যাপারে একবারেই অচেতন। মানুষের এত অভাব অভিযোগ শুনে তিনি তো নাকে শর্ষে তেল দিয়ে ঘুমিয়েছেন সেই কবে। এখনও জেগে উঠেননি। কিংবা আদৌ জেগে উঠবেন কিনা কেউ জানেন না। পরিষদ বর্গরা নাকি কেউ সেই শ্রষ্টা নামক মহা রাজাকে ডেকে জাগাবারও সাহস পাচ্ছেন না। তাতে চাকরী যাবে। এদিকে মহারাজাতো এ পৃথিবী নামক রাজ্যের ভালো মন্দের ভার দিয়েছেন কলির অবতারের হাতে। তিনি নাকি কিছুই বুঝেন না। তাঁর মতে রাজ্যে কি হচ্ছে না হচ্ছে তা নিয়ে মাথা ব্যথার কিছু নেয়। প্রজারা যা খুশী করুক। তাতে কোন অপরাধ নেয়। হত্যা, ধর্ষণ, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি যার যা খুশী করুক, কেবল আমার বকশীষটা ঠিক থাকলেই হলো। ব্যাস্। তিনি নাকি মুক্ত কন্ঠে ঘোষনা দিয়েছেন, এই ঈশ্বর যতদিন না জাগেন ততদিন আমি আছি। আর আমি যতদিন আছি ততদিন এভাবেই চলবে। আমাকে কেউ টলাতে পারবে না। ক্ষমতাধর সেই কলির অবতারের কাছে পার্ষদবর্গরাও নিশ্চুপ। তারাও ভাবছে আর শ্রষ্টার অপেক্ষায় থেকে লাভ কি, তবে এভাবেই চলুক।
চলবে…….