চাচি কাহিনী
আমার চাচি দুই পুত্র ও দুই কন্যা সন্তানের গর্বিতা মা। মেয়েদের বিয়ে দেওয়া ও ছেলেদের বিয়ে করানোর ষোল আনা কৃতিত্ব চাচির। চাচি জাত-বংশ, চেহারা-চরিত্র, আচার-ব্যবহার, শিক্ষা-দীক্ষা, অর্থ-সম্পদ ইত্যাদি বিষয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ করে খাঁটি সোনার মতো দু’খানা জামাই আর দুখানা বউ জোগাড় করে এনে ঘরে তুলেছেন। দশ পুরুষে যা না বুঝে চাচি নিজেই যে তার চেয়ে ঢের বেশি বুঝেন এ ব্যাপারে এলাকার লোকজনের মধ্যে কোনো সন্দেহ নেই। চাচি পাকা জহুরির মত যাচাই করে যা ঘরে এনেছেন তাতে যে কোনো খাদ থাকতে পারে না এ ব্যাপারে কারো দ্বি-মত নেই।
চাচি ছেলের সুখের ব্যাপারে যতটা না চিন্তিত, দুই কন্যার সুখের ব্যাপারে তিনি ততটা নিশ্চিত। কারণ ছেলে দুটো ঠিক মায়ের মত হয়ে উঠতে পারেনি। চাচির কঠিন শাসন-বারণের মধ্যে থেকেও ওরা কীভাবে যে বাবার স্বভাব চরিত্র পেয়ে গেছে এ রহস্য নিয়ে চাচি বহুবার বহুভাবে গবেষণা করেছেন কিন্তু এর কোনো কিনারা খুঁজে পাননি। মেয়ে দুটো চাচির মতো হয়েছে বলে তাদের সুখ-শান্তির ব্যাপারে চিন্তা করার কোনো প্রয়োজনই নেই। সুতরাং চাচির মত সুখী মা এলাকায় আরো আছে কি না তা সহজেই ফিক করে বলা যাবে না। চাচি নিতান্তই সুখী মানুষ।
বড় জামাই ব্যবসা করে, ছোটটা স্কুল শিক। মেয়েরা যখন স্বামীর বাড়ি থেকে মায়ের বাড়িতে মহা উৎসব আয়োজনে বেড়াতে আসে তখন চাচির আনন্দের আর সীমা থাকে না। দুই জামাই শাশুড়ির অকৃত্রিম আদর-আপ্যায়ন ও স্নেহ-ভালবাসায় সিক্ত হয়ে খুশিতে টগবগ করে। তারা জামাইয়ানা আদর পেয়ে গর্বে বুক ফুলিয়ে বন্ধু-বান্ধবদের কাছে নানা কথার ছলে ইনিয়ে বিনিয়ে শাশুড়ি বাড়ির সুনাম-সুখ্যাতির কথা কত যে বলে বেড়ায় তার শেষ নেই। স্ত্রীসোহাগী জামাই বাবুরা শ্বাশুড়ি বাড়ির যতœ-আত্তিতে সন্তুষ্ট চিত্তে বাড়ি ফেরে।
এত কিছু করার পরও জামাই বাবুরা চলে যাওয়ার সময় শাশুড়িআম্মা মুখে আঁচলের কোনা গুঁজে মাথা-পিঠ হাতিয়ে বলবেন, ’বাবাজীরা মনে কিছু নিও না। কি করতে কি যে করেছি আর কি খাওয়াতেই বা কি যে খাইয়েছি। খাওয়া-দাওয়া আমারই মন মতো হয়নি, তোমাদের মন ভরবে কীভাবে। তবু বাবা তোমাদের দু’জনকে একসাথে পেয়ে পরাণটা জুড়ালো। এটাই বড় সান্ত্বনা আমার। যাও বাবা! ফি আমানিল্লাহ্!’ -বলে আঁচলে চোখ মুছতে মুছতে ঘরে ফেরেন শাশুড়ি। আনন্দ উৎসাহে যাদের আগমন তাদের বিদায়টাও হয় খুব কষ্টের মধ্য দিয়ে।
চাচির ভাগ্যক্রমেই হোক আর বংশানুক্রমেই হোক মেয়ে দুটোর জামাই পেয়েছেন অসম্ভব স্ত্রীভক্ত। স্ত্রীর কথার বাইরে ওরা কোনো কথা বলা বা করার সাহস করেছেন এমন বদনাম ওদের নেই। স্ত্রীর শাসন-বারণ, আদেশ-উপদেশ আর মাতব্বরীতে দুই জামাই ও পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা সর্বদা থাকে তটস্থ। ওরা কামাই রোজগারটাই শুধু করে, আর বাদ বাকি সবকিছুর কর্তৃত্ব স্ত্রীর। সংসার, ধর্ম-ক¤র্ম, সামাজিকতা, আয়-ব্যয়, আইয়র-নাইয়র এ-সবই করে তারা। স্ত্রীর কাছ থেকে চেয়ে-চিন্তে পকেট খরচার টাকাটা নিয়ে ওরা বাইরে যায়। স্ত্রীর ওপর দিয়ে কোন কথা বলার মুরোদ নেই ওদের। স্ত্রী যেভাবে বলবে সে ভাবেই চলতে-বলতে হবে। শ্বশুর শাশুড়ি তো ছাই। ব্যতিক্রম হলে সংসারে অশান্তির কোন সীমা থাকবে না। অশান্তি চরম আকার ধারণ করলে যাকে উপোস করতে হয় এবং ঘর থেকে বাইরে গিয়ে রাত্রি যাপন করতে হয় তিনিই স্বামী। অতএব হিংস্র বাঘের সামনে নিরীহ হরিণের মত থাকাটাই শ্রেয় মনে করে স্বামী বেচারা অত্যন্ত শান্ত-সুবোধ ও অনুগত প্রাণীর ন্যায় এ সমাজ-সংসারে কোনমতে টিকে আছে। এতে কতটা সুখ, কতটা আনন্দ আর কতটা বেদনা আছে তারাই কেবল জানে। তবে পড়শীরা আড়ালে-আবডালে এদেরকে ’দজ্জাল বউ’ বলে মানে। এ সম্বোধনে কতটা আদর-সোহাগ, হিংসা-বিদ্বেষ আর ভয় লুকিয়ে আছে তা নিয়ে এ পর্যন্ত কেউ গবেষণা করতে সাহস করেনি। অতএব আমিই বা আগ বাড়িয়ে বিপদে পড়তে যাই কেন? সুতরাং আমিও কিচ্ছু জানি না!
যেটা জানি সেটা হলো এই স্নেহপরায়না মহান শ্বাশুড়ি মেয়ের জামাইদের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। যার কন্যা গৃহকর্তা স্বামীকে অঙ্গুলি নির্দেশে ওঠবস করায়, নিজের যোগ্যতা, শক্তি-সামর্থ আর জš§দাত্রী মায়ের আছর-আশীর্বাদে যারা সংসারের প্রভূতে পরিনত হয়েছে তাদের মায়ের মতো সুখী মা জগতে আর কয়টি আছে? অতএব তিনি মুখে পান পুরে আঙ্গুলের ডগায় চুন লাগিয়ে পাড়া বেড়িয়ে, আত্নীয়-স্বজনদের কাছে নানা কথায় মেয়ের সুখ-শান্তি, কর্তৃত্ব আর স্ত্রীর করতলগত দুই অনুগত স্বামীর প্রশংসা করবেন না তো কী? তিনি মেয়ের সুখ শান্তি আর কর্তৃত্বের জন্য যেমন আনন্দে গর্ব করেন তেমনি স্ত্রৈণ জামাইদের ভূয়সী প্রশংসা করে পাড়ার হিংসা-বিদ্বেষ উদ্রেক করে একাই পরম আনন্দ ও চরম সুখ উপভোগ করেন।
কিন্তু সমস্যা হলো নিজের ঘরের দুই বউকে নিয়ে। বড় বউটা কদাচিৎ কথা-বার্তা শুনতে চাইলেও ছোটটা বেজায় চড়া। পুত্রধনেরা স্ত্রীর কথামত চলে-বলে বিধায় মায়ের কষ্টের শেষ নেই। বাড়িতে যার পা পড়ে তার কাছেই দুই দজ্জাল বউয়ের বদনাম গীবৎ করে নাকের পানি চোখের পানি এক করে প্রলাপে-বিলাপে বাড়ি মাতিয়ে তোলেন চাচি। পোলাদের ডেকে বলবেন, মানুষ হলিনি তোরা, দুজনেই বউয়ের কোলে মাথা ফেলেছিস। মাথা বিক্রি করে দিয়েছিস। আমার মতো হলিনে; হলি গিয়ে বাবার মত মিনমিনে কাপুরুষ, বিলাই। লজ্জা করে না তোদের? মাগীদের কথায় চলিস। তোদের কপালে যে দুঃখ-দুর্গতি কত দিক থেকে কীভাবে এসে ঘাড়ে চড়ে বসবে এর কোনো কুল-কিনারা খুঁজে পাবি না তোরা। বউয়ের কথায় যে পুরুষ চলে তার কি মেরুদন্ড আছে রে। বাঘিনীর ঘর ধেকে শিয়াল ছানার জš§! যা তোদের মত মাইগ্যা পোলাদের সাথে আমার খাওয়া পরা কিছুতেই সম্ভব না। কোনো মাগীর কথা শুনে খাওয়ার পাত্রী আমি নই। তোরা আলাদা গিয়ে খা।
চাচি দুই পোলাকে হঠাৎ আলাদা করে দিলেন। মেয়ে দু’টোকে রাখল নিজের সাথেই। হাড়ি-পাতিল, বাসন-কোশন, লেপ-তোষক, চাল-ডাল, নুন-তেল ইত্যাদি সবই ভাগ-বাটোয়ার হলো। ঘর-দোর, রান্না-বান্না, থাকা-খাওয়া সবই আলাদা। কিন্তু ঝগড়াঝাটি রয়ে গেল একত্রেই। তবুও যে যেখানেই থাকুক না কেন বউ-শাশুড়ির কটুকাটব্যের অস্থির নাচনে সবাই তটস্থ। ঝগড়ার পর সবাই শরীর ঝকিয়ে, মুখ বাঁকিয়ে, সশব্দে কাজ করেন। পুরো বাড়িটার মধ্যে বেতাল ছন্দের একটা তাল-লয় আকার ইঙ্গিতে ভালই ঠাওর করা যায়।
মেয়েরা স্বামীদের নিয়ে মায়ের বাড়িতে বেড়াতে এলো। মা তাদের কাছে টেনে নিয়ে আবেগে, মান-অভিমানে, দুখে-কষ্টে আঁচলে মুখ মুছতে মুছতে দুই দজ্জাল বউ আর এদের অনুগত নিজের দুই কুলাঙ্গার পুত্র সন্তানের নানান কাহিনী বিচিত্রভাবে তুলে ধরলেন। মায়ের কান্নার জোর আর চোখের জলের প্রবাহ দেখে মেয়ে দুটো অগ্নিমূর্তি ধারণ না করে পানিমূর্তি ধারণ করে বসে রইল। তারা একগাল হাসি দিয়ে মায়ের পিঠ-মাথা হাতিয়ে মাকে শান্ত্বনার বাণী শোনাতে লাগল। দুই মেয়ে মায়ের প নিয়ে তিনটা লাফে ‘দুই মাগীর’ চুল ছিড়ছে না দেখে তিনি অঝর ধারায় কেঁদে বুক চাপড়াতে লাগলেন। মায়ের অসহায় কান্না শুনে তার দুই মেয়ে মনে মনে তাৎণিক একটা ছক একেঁ ফেললো। ভাবিদের যন্ত্রণার দেওয়ার মুরোদ কতটা হলে পরে এ মায়ের চোখে পানি আসতে পারে! মেয়ে দুটি ভাবছে আজ যদি মায়ের প নিয়ে ভাবিদের সাথে ঝগড়া করি তা হলে মা-বাবার অবর্তমানে এ বাড়িতে পা রাখার কোনো উপায় থাকবে না। বাবার বাড়ি হারানোর ষোলোআনা সম্ভাবনা ও যন্ত্রণাময় ভবিষ্যতের চিত্র এঁকে দু’বোন আপছে-আপ চুপসে গেল। মায়ের কান্নার তীব্র শব্দতরঙ্গ দু’মেয়ের কানে দ্যোতনা সৃষ্টি করতে পারেনি।
দুই মেয়ে মাকে এই বলে শান্ত্বনা দিতে লাগল যে, মা তোমার ভাগ্য ভাল যে আমাদের ভাই দুটো ঠিক তোমার মত ভাল শাশুড়ি ও বউ পেয়েছেন। তোমার আছর-আশীর্বাদে আমরা যেমন শ্বশুরালয়ে রাজত্ব করে খাচ্ছি, তোমার পোলার বউ দুটিও তোমার মত এভাবে রাজত্ব করছে. তোমার কিছু হলে পরে এ বাড়ির কর্তৃত্ব কে নেবে বল? এরাই তো তোমার যোগ্য উত্তরসূরী। এতে তো তোমার দুঃখ থাকার কথা নয়; খুশিই হবার কথা মা। এ কথা শেষ হতে না হতেই চাচি বিছার মতো লাফিয়ে উঠে লাত্থিমেরে খাট থেকে ফেলে দিল তার নেমকহারাম দুই মেয়েকে। মেয়েরা লাথি খেয়ে বাবাকে ভাইদের ডেকে কান্না আর অষ্পষ্ট কথায় বিরাট হাঙ্গামা বাধিয়ে ফেলল। তারা পারিবারিক নালিশ-বিচারে একচ্ছত্র আধিপত্য খাটিয়ে মাকে ভাই-বউদের ভাগে ফেলে বড় একটা কাজ স¤পাদন করার গৌরব নিয়ে বীরদর্পে স্বামীর বাড়িতে ফিরে গেল।
কিছুদিন পর মেয়েরা খবর পেল, তাদের মা এখন বেশ সুখে আছেন। শ্বাশুড়ির কথায় বউ না চললেও বউয়ের কথা অরে অরে পালন করছেন শ্বাশুড়ি। সারাদিন খাটা-খাটুনির বিনিময়ে তিন বেলা তিন থাল ভাত জুটছে চাচির কপালে।