সমুদ্র সৈকতের রাত
মাধবী আমার প্রেমিকা । ওর সঙ্গে রাগ করে একাই চলে এলাম পুরীতে ঘুরতে । অনেক দিন আগে থেকেই আমাদের মধ্যে কথা হয়ে ছিল–পুরীতে ঘুরতে যাব–না হয় একটা রাত কাটিয়েই চলে আসব–না হয় আলাদা বেডেই আলাদা রাত কাটাব ! এত সব কথা আগেভাগে হয়ে যাবার পরও শেষ পর্যন্ত মাধবী এলো না । আমার ভীষণ রাগ হয়ে ছিল । সে রাতেই পুরী এক্সপ্রেস ধরে একা চলে এলাম পুরীতে ।
এখানে আসার পর মনটা খারাপ লাগছিল । বুঝতে পারছিলাম রাগের মাথায় একা চলে আসা আমার উচিত হয় নি ।
কথা মত মাধবীর সামনে প্রস্তাব রেখে ছিলাম , আমাদের ফাইনাল পরীক্ষা হয়ে গেলে দুজনে মিলে ঘুরতে যাব ।
একচুয়েলি আমি, মাধবী দুজনে এক কলেজে, এক ক্লাসে পড়ি–বি.এস.সি.ফাইনাল ইয়ারে । ফাইনাল পরীক্ষা হয়ে যাবার পর ঘুরতে যাবার প্রস্তাবে মাধবী স্বেচ্ছায় রাজি হয়ে ছিল ।
কিন্তু যখন ঘুরতে যাবার সময় এলো তখন–
–না, না, তা কি করে হয় ! তুমি আমি দুজনে বাইরে ঘুরতে যেতে পারি ? মাধবী বলে উঠে ছিল।
–কেন না, কেন যেতে পারি না ? অনেকটা বিরক্তির সঙ্গেই আমি বলে উঠে ছিলাম ।
–তুমি বোঝো না, অবিবাহিত ছেলে মেয়েরা কখনো একা একা ঘরের বাইরে রাত কাটাতে পারে ?
–দেখো অনেক দিন ধরে আমাদের মেলা মেশা–মাঝে বিয়ে বিয়ে খেলাটা হয় নি বটে–
–বিয়ে বিয়ে খেলা! অনেকটা রাগের টোন নিয়েই বলে উঠে ছিল মাধবী ।
–মানে বিয়ের আগেই বিবাহিত সম্বন্ধের কথা বলছি–আমি অনেকটা আধুনিক হতে চাইলাম।
–সেটা অনিচ্ছায় কিছু যদি হয়ে যায়–, মাধবী তেমনি রাগত বলে উঠলো ।
আমার সামান্য টেম্পার এসে গেল, তার কিছুটা কারণ আবশ্য অনেক সময় ধরে কড়া রোদে ওর অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকার ব্যাপারটাও জড়িয়ে থাকবে । আমি বলে উঠলাম, তুমি তা হলে যাবে কথা দিয়ে ছিলে কেন ! এ সব মেয়েলি প্যানপ্যানানি এক দম ভালো লাগে না আমার, অনেক হয়েছে, এখন বল, আমি পুরী যাচ্ছি, তুমি যাবে কি না ?
মাধবীর মনও কোনও কারণে খারাপ ছিল কি ? না কি সেও অনেক খানি রোদ মাথায় লাগিয়ে এত দূর ত্রস্তে এসেছে ! ও বলে উঠল, তুমি যাচ্ছ ? একা ? যাও আমি যেতে পারব না ।
আমার কেমন জেদ চেপে গেল, মাধবীর একটা হাত টেনে ধরলাম, জোর জবরদস্তির মতই যেন বলে উঠলাম, তোমায় যেতে হবে—সব সময় এক কথা তোমার–আজ আর শুনব না ।
মাধবী রাগের মধ্যেই ছিল, এক হ্যাঁচকা টান মেরে হাতটা সরিয়ে নিয়ে আমার থেকে খানিকটা দূরে সরে গিয়ে বলে উঠে ছিল, আমি তোমার বিয়ে করা বউ না যে জোর করে নিয়ে যাবে–আর বিয়েটা তোমার কাছে ছেলে খেলা হতে পারে কিন্তু আমার কাছে নয় ।
আমিও তখন অনেকটা জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়ে ছিলাম—তাই বোধ হয় আচমকা ওর কাছে এগিয়ে গিয়েছিলাম, তারপরে ওকে একটা ধাক্কা মেরে দিয়ে বলে উঠতে গিয়ে ছিলাম, ঠিক আছে তোমার যেতে হবে না !
ধাক্কাটা কতটা জোরের হবে আন্দাজ ছিল না–মাধবী মাটিতে ধপাস করে পড়ে গিয়ে ছিল । আর ভীষণ অভিমানী রাগের লাল চোখ নিয়ে আমার দিকে কটমট করে তাকিয়ে বলে উঠে ছিল, তুমি আমার গায়ে হাত দিলে ? কেঁদে ফেলেছিল মাধবী, চীৎকার করে বলে উঠে ছিল, আই হেট ইউ–
ব্যথা পেয়েছে ভেবে ওর হাত ধরে উঠাতে এগিয়ে গিয়ে ছিলাম । ও ভীষণ রেগে গিয়ে ছিল, আমার হাত ছিটকিয়ে সরিয়ে দিয়ে ছিল, এক ঝটকায় দাঁড়িয়ে উঠে বলে ছিল, ভালবাসার মুখে ছাই–
কি, এত বড় কথা ! আমার ভীষণ অভিমান হল, না হয় ভুলে ধাক্কাটা সামান্য জোরেই হয়ে গিয়েছিল, তাই বলে ভালবাসার ওপর এত বড় কথা ! আমিও মুখিয়ে উঠলাম, তোমার ভালবাসায় পরোয়া নেই, বলে হাতের বুড়ো আঙুল দেখিয়ে দিলাম মাধবীকে ।
মাধবী আমার বুড়ো আঙুলের দিকে তাকিয়ে এক হাতে চোখের জল মুছতে মুছতে হনহন করে চলে গেল । আমিও কম যাই না, গটগট করে মাধবীকে ছেড়ে চলে এলাম বাড়িতে । জামা কাপড় দু চারটে গুছিয়ে এটাচিতে ভরে মাকে, বন্ধুর বাড়ি যাচ্ছি, বলে বেরিয়ে গেলাম ।
রাগে রক্ত চাপ বেড়েই ছিল–সোজা পুরী এক্সপ্রেস ধরে একাই পৌঁছে গেলাম পুরী ।
সমুদ্রের প্রায় গা ঘেঁষা এক হোটেলে গিয়ে উঠলাম । হোটেলের রুমে ঢুকে সোজা বিছানায় ঢলে গেলাম । ট্রেনে সারা রাত ঘুম হয় নি । মাথা চড়া ছিল । মাধবীর সঙ্গে দীর্ঘ পাঁচ বছরের প্রেম গাঁথার নানা কথা মনে আসছিল । আর কালকের ঘটনার কথা মনে হতেই আবার দপ করে মাথাটা বেশ ধরে গিয়েছিল । ঘুম যখন ভাঙল বেলা তখন একটার কাছাকাছি । খিদেতে পেট চোঁ চাঁ করছিল । বেয়ারাকে কল করে, লাঞ্চ, রুমেই দিয়ে যেতে বললাম। ইতিমধ্যে স্নান সেরে নিয়ে ছিলাম । খেয়ে নিয়ে আবার শুয়ে পড়লাম । একটানা ঘুমে বিকেল হয়ে গেল । বিছানাতে শুয়ে ভাবছিলাম ব্যাপারটা এমন হওয়া উচিত ছিল না । হুট করে মাধবীর ওপর রাগ করে এখানে চলে আসা ঠিক হয় নি । নিজের ভুলটাও যেন বোধগম্য হচ্ছিল, ভাবলাম, একবার ফোন করব কি মাধবীকে ? না, মন বলল, না আর একটা দিন থাক । ওর রাগ এখনও হয়তো পড়ে নি ।
সন্ধ্যা হয় হয়, বিছানা ছেড়ে উঠলাম । রুমের এক দিকের জানলা খুলে দিলাম–সমুদ্রের গর্জন স্পষ্ট কানে এলো । বন্ধ ঘর থেকেও অস্পষ্ট চাপা গর্জনের শব্দ যে পাচ্ছিলাম না তা নয় । জানলার পাশের দরজা খুলে দিয়ে দেখলাম ছোট্ট ব্যালকনি । দুটো চেয়ারও তাতে পাতা আছে।
সামনে দিয়ে বড় রাস্তা চলে গেছে–জোরালো স্ট্রিট লাইট জ্বলছে । রাস্তা পার করেই সমুদ্র–ঢেউ ভেঙে যাওয়া সাদা বুদবুদ ফেনার ঝাঁক চোখে পড়ল, সমুদ্রের জল আবছা অন্ধকারে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল না, তীরে আছাড় খেয়ে পড়া ঢেউয়ের শব্দ পাচ্ছিলাম ।
দিন ভর সমুদ্র দর্শন হল না–মনটা বড় ভারাক্রান্ত–মাধবীর কথা খুব করে মনে পড়ছিল । বেচারাকে রাগের মাথায় অমন ভাবে ধাক্কা মারা আমার উচিত হয় নি । কিন্তু আমিও কি জানতাম যে ওই সামান্য ধাক্কাতেই ও মাটিতে ছিটকে গিয়ে পড়বে ! না, একা বসে বসে ভালো লাগছিল না–তার চে বরং হোটেলের তিন তালা থেকে নিচে নেমে রেস্টুরেন্টে চা, নাস্তা সেরে সমুদ্র পারে একটু হেঁটে আসা যাক ।
ক্রমশ…