উপদেশ লাগবনি, উপদেশ!
খালি উপদেশ আর উপদেশ। উপদেশ শুনতে শুনতে আমি বিরক্ত। আর ভাল লাগে না। কেন, জানেন? তাহলে শুনুন-
এ যাবৎ আমি যা কিছু পেয়েছি, সবচেয়ে বেশি পেয়েছি এখনও পাচ্ছি সেটা হলো উপদেশ। একবার মনে হয় এর চেয়ে সস্তা জিনিস দুনিয়াতে আর নেই। আবার মনে হয় এর চেয়ে দরকারী জিনিসও আর নেই।
সকাল থেকে শুরু করে ঘুমানোর আগ পর্যন্ত উপদেশের ছড়াছড়ি।
একদিন ঠাণ্ডা জ্বর নিয়ে স্কুলে গেলাম, স্যারেরা তো কত রকমের উপদেশ দিলেন, পরে দিলেন সহপাঠীরা, শেষে ক্লাস ফোর-এর এক ছাত্রী আমার জ্বরের কথা শুনল এবং আমার দিকে ডাক্তারের মত কতক্ষণ তাকিয়ে থেকে দিল ইয়া বড় একটা উপদেশ। সে বলে, ‘আপু তুমি একটুও ডরাইও না, বাসায় গিয়ে তিনটা কাঁচামরিচ চিবাইয়া খাইয়া এক গেলাস ঠাণ্ডা পানি খাইবা, দেখবানে ঠাণ্ডা জ্বর পলাইবার জায়গা পাইত না, বাপ ডাইক্কা পলাইবে, হু।’
পরীক্ষার সময় জোঁকের মতো লেগে থাকবে মা-বাবা আর দিবে নানান উপদেশ। তাঁদের যন্ত্রণায় মাঝেমধ্যে আমি লাফিয়ে উঠি। কথা শুনে মনে হয় আমি কিচ্ছু বুঝি না। না শুনলে বলে বেয়াদব মাইয়া উপদেশ শোনে না। এত এত উপদেশ কোনটা কোথায় রাখি বলুন।
স্কুলে যাওয়ার সময় দাদু বলবে, এই ছেরি বেশি লাফালাফি করবে না, শরীর-মাথা ভালো কইরে ঢাইক্কা-ঢুইক্কা যাইও, দাঁত বের করে হাসবে না, নিচের দিকে তাকিয়ে হাঁটবে, মুরুব্বীদের সালাম দিও… এমন হাজারটা।
চলাফেরায়, স্কুলে, বাসায়, পথে যখন যার সাথে দেখা হবে সেই একটা না একটা উপদেশ করে যাবে।
উপদেশ ভাল লাগে না। যখন বলে কেউ বিরক্ত লাগে। কিন্তু উপদেশটা তো কানে শুনেছি, দেখা গেছে সেই উপদেশটা অনেক পরে হলেও কাজে লেগে গেছে। কত মজার ব্যাপার না?
পথে আমাদের হুজুরের সাথে দেখা হলেই বলবে, মা শোনো শোনো, পথে চলার সময় কটর কটর কথা না বলে, হাসি-তামশা না করে যদি … এই দোয়াটা পড়তে পড়তে যাও তাহলে বিরাট উপকার। এ দোয়ায় তোমাদের এলেম আর জ্ঞান বাড়িয়ে দিবেন আল্লাহ্। মাথা ঝাকিয়ে বললাম, `আইচ্ছা হুজুর, পড়তে পড়তে যামুনে।’
পারিবারিক বৈঠকেও খালি উপদেশ আর উপদেশ।
কে কী উপদেশ দেয়, আমি উপদেশগুলো এখানে উল্লেখ করলাম না। কারণ উপদেশগুলো যে কী তা সবাই জানেন। সবাই সবখানে শোনেও থাকবেন।
একটা উপদেশের কথা বলতে ইচ্ছে করছে আমার। বাড়ি থেকে এক চাচা এলেন। মেজাজ দেখি খুব খারাপ। খালি ফোঁসফাঁস করছে। বাবাকে আঙ্গুল খাঁড়া করে বলছেন, `তুমি যদি দেখ যে একটা লোক তোমার সামনে পানিতে পড়ে ডুবে মরছে, তুমি দেখেও কিছুই করতে যাবে না যতক্ষণ না সে বলে, আমাকে বাঁচাও। আমি নিজে আগ বাড়িয়ে উপকার করে এখন মহা ঝামেলার মধ্যে আছি।’
আমি চাচার কথা শুনে ফিক করে হেসে দিতেই তিনি ডেকে নিয়ে বললেন, `মা, হাসলে কেন তুমি? এটা মোটেও হাসির কথা না। এটা, মহামূললবান কথা। সারাজীবন মনে রাখবা।’ `মাথা কাৎ করে বল্লাম, `আইচ্ছা।’
যতই বড় হচ্ছি ততই দেখছি, আমাদের পুরো জীবনটা উপদেশ দিয়ে গড়া। যদি মনে করি, আচ্ছা আমাকে কেউ কোন উপদেশ দিল না, তাহলে আমি কেমন হতাম? `ঘোড়ার আণ্ডা হতাম।’