মেঘের কোলে রোদ-৭
হামিদ মিঞার বারান্দার এক পাশে চুপ করে বসে আছেন
শিবু।চোখ দিয়ে পানি ঝরছে। শিবু এদিক-ওদিক তাকিয়ে
পাঞ্জাবির হাতা তা মুচছেন।
প্রবাদ আছে, কৃপণের অশ্রু পয়সা ছাড়া ঝরে না।
এই এলাকার প্রবাদ প্রতিম কৃপণ শিবু মন্ডলকে দেখলে
এই প্রবাদ যারা আওড়ায় তাদের ভুল ভাঙতো।
হামিদ মিঞা সহপাঠী ছিলেন শিবুর। আজ সকালে
ইন্তেকাল করেছেন।খবরটা পেয়ে বুক ধড়াস করে উঠেছিল
শিবুর, এত তাড়াতাড়ি চলে গেল হামিদ?
গতকাল শিবু যখন বাজারে যাচ্ছিলেন তখনই দেখা হামিদের
সঙ্গে, সাইকেলে বাজার থেকে ফিরছিল।
সাইকেল থামিয়ে দুজনে একটু হাঁফ নিয়েছেন। বট গাছের নিচে
বসে দু-দন্ড জিরিয়ে নিয়েছেন। শিবুর দিকে সিগারেট এগিয়ে দিতে
দিতে বলেছেন,এতদিন যা করলাম সবই ভুল মনে হচ্ছে-রে।
হামিদের সিগারেটের প্যাকেট এগিয়ে দেওয়া দেখে চমকে উঠে
ছিলেন শিবু।এখন কথা শুনে তিনি নিশ্চিত হলেন,পরিবর্তন এলে
সবার মনেই আসে।বললেন,কেন ভুল কেন?
—ছেলেগুলো দেখছি ভাল রকম বিগড়ে গেছে,হাট-বাজারও আসতে
চায়ছে না। এতদিন তো আমিই করলাম, আজ একটু গা-হাত-পা
ম্যাজম্যাজ করছে,বললাম,তোরা কেউ যা। বড় বলে,মেজ যাক,মেজ
বলে,মাথায় লাগছে সেজ যাক।সবারই নিজের নিজের অজুহাত। তাই
নিজেই চলে এলাম।
—তা ভাল করেছিস,কি আনলি বাজার থেকে?
—দু-কেজি খাসির মাংস,আলু,কফি-টমাটো।ছেলেদের কথা ভেবে
অনেক কিপটেমি করেছি,এবার ভাবছি যা খেতে ইচ্ছে হয় খাব।
—ঠিকই তো, তোর ছেলেরা তো ব্যবসা-পাতি করছে,এখন তো
তোর আয়েশের সময়।
তখন শিবু কল্পনাও করেননি, একদিনেই আরাম-আয়েশ শেষ হয়ে
যাবে হামিদের।
হামিদের নাকি স্ট্রোক হয়েছিল।ছেলেরা ডাক্তারের কাছে যাওয়ার কথা
নাকি চিন্তাও করেনি।পড়শীরা বলাবলি করছে অনেক কথা। তার মধ্যে
কোনটা সত্যি,কোনটা মিথ্যে বোঝা মুশকিল। তবে সবই যে বানানো
নয় তা বোঝা যাচ্ছে, ছেলেদের বর্তমান আচরণে।
গাঁ-ভিন গাঁয়ের শ-পাঁচেক লোক জমা হয়েছে,তাদের এখনও এক
গ্লাস পানি খেতেও বলেনি কেউ।
ছেলেরা সাফাই গায়ছে,আব্বা তো কিছুই রেখে যাননি,আমাদের ব্যবসা
তো সব লসে চলছে,খরচপাতি করার কোন ক্ষমতা নাই।
বিরক্ত শিবু বলেছিলেন,কত খরচ হবে খানাখানিচায়,আমি দেব।
পাশ থেকে এক মৌলভী সাহেব বলে উঠলেন,হিন্দুর টাকায়
মুসলমানের খানাখানিচা না-জায়েজ।
শিবু তাই এসে বসেছেন নিরালায়।একাকী অশ্রু বিসর্জন
করছেন। বন্ধুর শেষদিনে এর বেশী কিছু করার অধিকার নাই
তাঁর।
—বাবা,বাড়ি চল,সকাল থেকে কিছু খাওনি তুমি।
অতসী তার বান্ধবীকে নিয়ে এসে দাঁড়িয়েছে সামনে।শিবু বললেন,
যাব,কিন্তু এদিকের কি-সব ব্যবস্থা হলো বুঝতে পারছি না।
ঠিক তখনই তাঁর সামনে এসে দাঁড়াল পাঞ্জাবিতে কাদামাখা
হায়দার। তার পেছনে জাল কাধেঁ কয়েকজন লোক।কয়েকজনের
মাথায় বড়-বড় হাঁড়িতে মাছ। সে গুলো তখনও তড়পাচ্ছে বাঁচার
আশায়।
তপতী মৃদু হেসে বলল, আর চিন্তা নাই বাবা,সারা গ্রামের চিন্তার
ঠিকেদারী যিনি নিয়েছেন,তিনি ময়দানে হাজির।
তপতীর কটাক্ষ-বাক্য শুনেও শুনলেন না শিবু। তিনি উঠে
দাঁড়ালেন হায়দারের সামনে। বললেন, কোথা থেকে আনলে
এসব?
— কোন রকমে ব্যবস্থা করলাম। বলে লাজুক হাসল হায়দার।
—অন্য সব ব্যবস্থা?
— কিচ্ছু ভাববেন না কাকু,সব ঠিক হয়ে যাবে।এই তোরা
মাছগুলো এখানে রেখে,চা-পানির ব্যবস্থা কর।
তপতী কথাগুলো শুনলো।বিড়বিড় করল,উনি শুধু গ্রামের লোকের
ভালমন্দ চিন্তা করবেন,নিজের কথা ভাববেন না কোনদিন।
তপতীর পাশে দাঁড়িয়ে থাকা রোমিলা এতক্ষণ অবাক চোখে
হায়দারকে লক্ষ্য করছিল। তপতীর কথায় সম্বিত ফিরল যেন
তার। বলল,কি বলছিস?
—কি আর বলবো,এই সেই লোক, যে কিনা কার মেয়ের বিয়ে
হয় না,কার অসুখ এসব নিয়েই মেতে থাকেন,নিজের কথা
চিন্তাও করেন না।
—কে বলল নিজের কথা চিন্তা করে না,যে লোক কুকুরের ভয়ে
পথ হাঁটে না,সে নিজের কথাই সবচেয়ে বেশী ভাবে।
তপতী অবাক হয়ে বলল,তার মানে?
—এই ছেলেটার সাথেই আমি সেদিন এসেছি,ভীষণ ভীতু আর
চরম অহঙ্কারী একজন।
— সে আর বলতে, আমাদের দিকে একবার তাকিয়েও দেখল না,
বল?
দুই বান্ধবী পরস্পরের দিকে চেয়ে রইল কৌতুহল নিয়ে।
(পরের কথা আগামী পর্বে)