Today 12 Oct 2025
Top today
Welcome to cholontika

বিজয়

: | : ১৯/০৯/২০১৩

আগামীকাল ষোলই ডিসেম্বর। মহান বিজয় দিবস। নবীনগর হাই স্কুলের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি আলহাজ্ব আঃ রহমান আমাকে বিজয় দিবসের কুচকাওয়াজ ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকার অনুরোধ জানিয়েছেন। বিজয়। আমার ছেলে নাম। আগামীকাল ওর বয়স ৪০ বছর পূর্ণ হবে। চোখের সামনে আজো ভাসে সেদিনগুলোর কথা।

 

আমি প্রচন্ত প্রসব যন্ত্রণায় ছটফট করছি। আমাকে সাহস দেবার কেউ নেই বললে ভুল হবে। মাথার উপর খোলা আকাশ, কালো রঙের একটি গিরগিটি অবিরাম ছোটাছুটি, শকুনের চক্রাকার ভ্রমণ আমাকে সাহস দিচ্ছে। বলছে ভয় নেই। তুমি নিজেকে একা ভেব না। আমার তোমার পাশেই আছি। একটা ভাঙ্গা পরিত্যক্ত বাড়িতে আমি একটা ফুটফুটে চাঁদের জন্ম দেই। সেই চাঁদে কোন কলঙ্ক নেই, খুঁত নেই। জন্মমাত্র সে প্রচন্ত চিৎকারে আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে দেয়। ভয়ে বিস্ময়ে আনন্দে আর আতঙ্কে আমি আমার সদ্য জন্ম নেয়া দেবশিশুটির দিকে তাকিয়ে থাকি। আমার সন্তান কেঁদে কেঁদে আমাকে সাহস জোগায়। বলে ভয় নেই মা, ভয় নেই। আমি আছি তোমার পাশে।

 

আমার স্বামীর নাম আতাহার। পেশায় একজন স্কুল শিক্ষক। ছাত্রদের ইংরেজী পড়াতেন। বেচারা ইংরেজীর শিক্ষক হলে কি হবে, মাতৃভাষা ও মাতৃভূমির প্রতি ছিল তার অসীম ভক্তি আর মমতা। ছাত্রদের পড়াতে পড়াতে প্রায়ই তিনি কোথায় যেন হারিয়ে যেতেন, কি সব ভাবতেন। কতশত যে চিন্তা করতেন তার কোন ইয়াত্তা নেই। আবার হঠাৎ বাস্তবে ফিরে এসে ছাত্রদের বলত, তোরা নিজের মাকে যেমন ভালবাসিস মাতৃভূমিকে তেমনি ভালোবাসবি। তার শিষ্যগণ কেউ বুঝে কেউ হয়তো না বুঝেই প্রিয় শিক্ষকের কথায় মাথা দোলাত। ও আমাকে প্রায়ই বলত বুঝলে শীলা, তোমার বাবার দেশভক্তি আর সমাজ সেবার নমুনা দেখেই তোমাকে বিয়ে করেছি। তোরা রূপ গুণ দেখে নয়। আমি ওর দিকে অপলদৃষ্টিতে চেয়ে থেকে ভাবতাম, মানুষটা দেশ ছাড়া কি আর কিছুই বোঝে না। অথচ এই মানুষটাই আমার স্বামী। আমার পেটে তিল তিল করে বেড়ে ওঠা সন্তানের জনক। হয়তোবা আমিই তাকে ঠিক বুঝতে পারি না।

 

সেদিন সকাল থেকেই আমার শরীরটা ভাল না। মনের মধ্যে একটা অজানা ভয় কাজ করছিল। আকাশটা ছিল মেঘাচ্ছন্ন। বাড়িতে আমি আর আতাহার ছাড়া দ্বিতীয় কোন জনমানব নেই। সারা গ্রামে একটা নিরব আতঙ্ক বিরাজ করছে। আতাহারের বড় ভাই ও ভাবী ওকে বারবার বুঝিয়েও কোন কাজে দেয়নি। বড় ভাই বলল, দেশের অবস্থা ভাল না। মিলিটারীরা গ্রামে গ্রামে হানা দিয়ে ঘর-বাড়ী সব জ্বালীয়ে দিচ্ছে। যুবক ছেলেদের ধরে নিয়ে গিয়ে গুলি করে হত্যা করছে। আতাহার, চল আমরা গ্রাম ছেড়ে নিরাপদ কোন জায়গায় চলে যাই। তাছাড়া তোর বৌটাতো গর্ভবতী। কখন কি হয় বলা যায়? কিন্তু ওর ওই এক কথা। আমি গ্রাম ছেড়ে কোথাও যাব না। এই গ্রাম দেশ জনগণ আমার মা। মাকে ফেলে আমি দূরে থাকতে পারব না। যেতে হলে তোমরা যাও। আমি গেলে আমার স্কুলের কি হবে, ওটা চালাবে কে? বড় ভাই ও ভাবী ওকে বোঝাতে না পেরে চোখের জল মুছতে মুছতে চলে গেল। যাওয়ার আগে বড় ভাবী কান্না জড়ানো কন্ঠে আমাকে বলল, ভাল থাকিস রে শীলা!

 

প্রধান শিক্ষক বোরহান উদ্দিন আমাদের বাড়িতে এল সকাল ৮টা নাগাদ। এসে ওকে বলল, আতাহার গ্রামে মিলিটারী নামছে। ওরা স্কুলে ক্যাম্প খুলছে। আমি স্কুলে গিয়ে ওদের দেখে প্রচন্ত ভয় পেয়েছি। আমাকে ডেকে গ্রামের অবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইল। আমি ঊর্দূ তেমন না জানায় আমতা আমতা করে বলেছি যে আমাদের স্কুলের ইংরেজী টিচার আতাহার এলেই হুজুরদের সব বুঝিয়ে বলতে পারবে। হেড স্যার বলল, আতাহার তুমি তাড়াতাড়ি আমার সাথে চল। স্যারের কথামত ও স্কুলে যাওয়ার আগে আমাকে গ্রামের শেষ মাথায় একটা ভাঙ্গা পোড়া বাড়িতে রেখে এল। যাওয়ার আগে বলল শীলা, ভয় নেই। আমি যদি আর না ফিরি তবে দুঃখ করো না। আর আমার সন্তান যদি স্বাধীন দেশের নাগরিক হয়ে জন্মায় হতে ওর নাম রেখ বিজয়। আমি ওর কথা শুনে চমকে উঠি। অবচেনত মন বলে, ওকে ফেরানো যাবে না। তাই বৃথা চেষ্টাও করিনি। জানি লাভ হবে না। আমি আতাহারকে বাঁধা দেইনি। ওর যাওয়ার পথে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকি। বুঝতে পারি আমার সন্তান পৃথিবীর আলোয় আসছে। বিজয় আসছে। এক সময় বিজয় আসে। সমস্ত যন্ত্রণা আর শোকের মুখে লাথি দিয়ে বিজয় আসে।

 

আমি অনেক পরে জানতে পারি হেড স্যারের কারসাজিতে আতাহারকে ডেকে নিয়ে গিয়ে হত্যা করা হয়। ওর মৃত্যুতে আমার কোন দুঃখ নেই। আমি ওর কথামতো আমাদের সন্তানের নাম রেখেছি বিজয়। বিজয়ের জন্ম হয়েছিল ষোলই ডিসেম্বর ১৯৭১ সনের বিকেলে। ওর জন্মের সময় আমি যেন পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছিলাম ঘাতকের বুলেট আতাহারের বুক ভেদ করল। ও লুটিয়ে পড়ল মাটিতে। ওর রক্ত তীর বেগে ছুটে মুক্তির আনন্দে মাটি ভিজিয়ে দিতে লাগল। তখন সুতীব্র চিৎকারে আমার সন্তান বিজয় আমাকে জানিয়ে দিল মা আসি এসেছি। তোমার কোন ভয় নেই মা। কোন ভয় নেই। আমি এসেছি……………..

লেখক সম্পর্কে জানুন |
সর্বমোট পোস্ট: ০ টি
সর্বমোট মন্তব্য: ১ টি
নিবন্ধন করেছেন: মিনিটে

মন্তব্য করুন

go_top