সমুদ্র সৈকতের রাত (দ্বিতীয় পর্ব)
চা, নাস্তা করে রাতের খাবারের অর্ডার দিয়ে সমুদ্র পারের দিকে বেরিয়ে গেলাম । সৈকতে আবছা আবছা অন্ধকার, মাঝে মধ্যে দু একটা ঠেলার দোকানে ব্যাটারির টিমটিমে আলো জ্বলছে । পারের এক দিকে আমার থেকে সামান্য দূরে দেখলাম–বেশ জমজমাট–অনেক আলো–ভিড়ের জটলা ঘিরে আছে । ওটা স্বর্গ দ্বার । ওর পাশটাতেই রয়েছে শ্মশানঘাট । সম্ভবত এই শ্মশানঘাটের জন্যেই স্বর্গদ্বার নাম হয়েছে ও জাগার । ওখানে সমুদ্রপার ঘিরে বিস্তৃত জাগা নিয়ে প্রতিদিন বিকেলে মেলা বসে । ঠিক তার উল্টো দিকে তাকিয়ে দেখলাম, বড় নির্জনতা– সুনসান।
লোকালয় ভালো লাগছিল না–তাই নির্জনতার দিকে এগিয়ে চলছিলাম । আশপাশের দু চারজন লোক অন্ধকারেই সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে আছে । ঢেউয়ের মাথার ফেনাগুলি চকমকি ফসফরাসের আলো নিয়ে জ্বলে উঠছে । কয়েকটা ছেলে মেয়ে তীরে উঠে আসা ঢেউয়ের জলে পা ছুঁয়ে ছুঁয়ে খেলে বেড়াচ্ছিল । আমি এগিয়ে যাচ্ছিলাম–ক্রমশ: ঘন নির্জনতার দিকে । চার দিকে তাকিয়ে দেখার চেষ্টা করলাম, হ্যাঁ, এখনও দু একজন লোক এধারে ওধারে ঘুরে বেড়াচ্ছে । আরও নীরবতা চাইছিলাম–যেখানে শুধু মাত্র আমি একলা বসে মহাসমুদ্রের গর্জন শুনব । এ ছাড়া আর কিছুই যেন ভালো লাগছিল না ।
হাঁটতে হাঁটতে বেশ দূরে এগিয়ে এসেছি–এদিকে কোন জন প্রাণীর দেখা পাচ্ছিলাম না । সামনে ছায়া ছায়া মত নুলিয়াদের তৈরি ছাতি ঘর চোখে পড়ল । তার মানে দিনের বেলায় এখানের তীরেও মানুষ স্নান করতে আসে ! পারের ওপরের দিকে স্পষ্ট কিছুই দেখা যাচ্ছিল না–একটা দুটো বাড়িঘর যেন রয়েছে ওখানে । নতুন কনস্ট্রাকশন চলছে–এমনও হতে পারে । আবার কোন পড়ো, পুরনো ঘর বাড়িও হতে পারে । অন্ধকারের মধ্যে পড়ো বাড়ি মনে হবার সঙ্গে সঙ্গে কেন যেন মনে স্ট্রাইক হল–কোন ভূতুড়ে বাড়ি নয় তো ! যেমনটা গল্প উপন্যাসে পড়ে থাকি! অন্য কিছু ভাবতে চাইলাম না । আর একশ পায়ের মত এগোলেই নুলিয়াদের ছাতিঘর । এমনি সময় হঠাৎ আমার চোখে পড়ল, ওখানে কেউ যেন দাঁড়িয়ে আছে ! আমার দৃষ্টি পড়ার সঙ্গে সঙ্গে মনে হল আধছায়া মত কিছু একটা সরে গেল—সে ছায়া মূর্তি ছাতি ঘরের স্তম্ভ খুঁটির আড়াল হয়ে গেল—কে ? কি হতে পারে ? মনে মনে প্রশ্ন করলাম । এগিয়ে যাবার গতি ধীর করে দিলাম । মনে করতে চাইলাম পকেটে টাকা পয়সা বেশী আছে কি না । আছে–তবে বেশী না–এই শ তিনেক হতে পারে । প্রায় হাত পনের দূরে খুঁটির দিকে নজর পড়ল আমার—এ কি, কারো শাড়ির আঁচল হওয়ায় উড়ছে বলে মনে হচ্ছে না ! তবে কি কোন মহিলা ? থমকে দাঁড়িয়ে গেলাম । এবার মনে ভয় ঢুকে গেল–আশপাশে কেউ নেই–অন্ধকারের মধ্যে আমার তাই মনে হয়েছিল । এই বিরান সমুদ্র সৈকত–এখানে তবে কে হতে পারে ! কৃষ্ণ পক্ষের রাত বলেই মনে হয়–এক ফালি চাঁদ নিশ্চয় আকাশের কোনায় উঠে থাকবে । তাই ক্রমশ নিভু নিভু আগুন আলোর মত চারদিকে আবছা লাল আভা ব্যাপে যাচ্ছিল । এখন কি করা যায় ভাবছিলাম । সামনে এগোবো, নাকি পেছনে–যে দিক থেকে এসেছি সে দিকে ফিরে যাব–কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলাম না । ঠিক এমনি সময় হাওয়ায় ভাসা ঈষৎ কেঁপে ওঠা মৃদু একটি মেয়েলি কণ্ঠ শুনতে পেলাম, এত ক্ষীণ শব্দ যে সেটা সত্যি মানুষের কণ্ঠ, না সামুদ্রিক হওয়ার প্রবাহমান সুর–ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলাম না ।
না, সামনে বিপদ…আমার মন যেন বলছে–কিন্তু…কি বিপদ..কি ধরনের বিপদ ! আমি নিজের শরীরকে টার্ন নিয়িয়ে সন্তর্পণে ফিরলাম, হোটেলের দিকেই ফিরে যাবো ভেবে নিলাম । ঠিক এমনি সময় কেউ কি ডেকে উঠলো ! মনে হল কেউ যেন আমার নাম ধরে ডেকে উঠলো ! মনের মধ্যে ভয় ঢুকে গেলে–মস্তিষ্ক বিহ্বল হয়ে পড়লে তার ভাবনা চিন্তার স্বাভাবিকতা নাকি সরে যেতে থাকে—উল্টাপাল্টা, অলৌকিক কিছু দেখা শোনার রহস্যের জগত নাকি সৃষ্টি হতে থাকে । এমনি ধরনের কথা আমি এক সাইকোলজির প্রফেসরের কাছে কোন এক দিন শুনে ছিলাম বটে !
…তপন ! …
না, হওয়ায় উড়ে আসার মত আওয়াজ হলেও এবার বড় স্পষ্ট আমার কানে নিজের নামটা যেন ঢুকে পড়ল ! ঘুরে তাকালাম ওই ছাতিঘরের দিকে । আর এ কি ! এক নারী মূর্ত দাঁড়িয়ে আছে সেখানে !
তখন, কে ? কে ? চাপা এক চীত্কার নিজের অজান্তেই যেন বেরিয়ে এলো আমার মুখ থেকে !
মাধবী…অবিকল…মাধবীর মত…এক আলোছায়ার নারীমূর্তি এগিয়ে আসছে আমার দিকে । ধীরে ধীরে ছায়া মূর্তি আমার কাছে এগিয়ে আসছে আর সত্যি ক্রমশ মাধবীর রূপ ফুটে উঠছিল তার মধ্যে থেকে ।
আমি আঁতকে উঠলাম, কণ্ঠ থেকে ক্ষীণ স্বর বেরিয়ে এলো, মাধবী তুমি ?
আরও কাছে এসে গেল মাধবী । বিস্ময়ে বাকশুন্য হয়ে তাকিয়ে ছিলাম, হ্যাঁ, ওই তো ! ওর মুখে হালকা হাসি ফুটে আছে । যেমনটি ওর চলন বলন ঠিক তেমনটি করে ও বলে উঠলো, কি ? শুনতে পারছ না আমার ডাক ?
–তুমি, মাধবী, এখানে ?
–হ্যাঁ, বিশ্বাস হচ্ছে না ? ঈষৎ হেসে ও বলল, তোমার রাগ ভাঙতে এসে গেলাম আমি ।
–আর, আর, আমি যে এখানে আসব-–তুমি জানলে কি করে ? ভয়ে ভয়ে কেটে কেটে আমি কথাগুলি বলে উঠলাম ।
–আমি সব জানি, সব বলে দিতে পারি ! খিলখিল হেসে উঠলো মাধবী ।
আমি ভীত, হতভম্ব, তুমি একা এখানে এসে গেলে—এই নির্জন–?
–তা কেন! মাকে নিয়ে এসেছি সঙ্গে ।
–মাকে? অজান্তেই আমার মুখ থেকে বেরিয়ে এলো এমনি প্রশ্ন ।
–কেন, ওই দেখো মা, সমুদ্রের ঢেউ গুনছে…মাধবী হেসে ঈষৎ শরীর দুলিয়ে বলে উঠলো—মনে হল এক হাত শূন্যে তুলে আঙুল দিয়ে দূরের দিকে দেখাল ।
একটা ভয় জড়িয়ে ধরছিল আমাকে । আমি তাকালাম সে দিকে । হ্যাঁ, এক মহিলাকে, আলোছায়ার দেহে সমুদ্রের কিনারা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে বলে মনে হল ! সে ছবি সমুদ্রের দিকেই উদাসী দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে ! চাঁদের আগুনের লাল আভা তখন অনেক পরিষ্কার হয়ে উঠছিল । তা হলে ঘটনা বাস্তবই হবে–আমার অবচেতন মন তখন মাটির তলায় শিকড় গাড়তে শুরু করল । কিছুটা স্বাভাবিক হতে চেষ্টা করলাম, তা হলে এই নিরালা তীরে তোমরা দুজন মাত্র এলে কি করে ?
আবার হাসল মাধবী, কেন, ওই যে আমাদের হোটেল, মাধবী আঙুলের ইশারা করে পারের ছায়াঘন পড়ো ভুতুড়ে বাড়িটা দেখিয়ে বলে উঠলো ।
আমার মন যেন বিশ্বাস করতে চাই ছিল না, বললাম, এত অন্ধকার কেন ওখানে ?
–লোড শেডিং চলছে এখন—কিছু সময় পরেই দেখবে সব আলোতে ঝলমল করে উঠবে !
ক্রমশ…