Today 12 Oct 2025
Top today
Welcome to cholontika

রক্ত

: | : ১৯/০৯/২০১৩

roktoকক্সবাজারে আসার একদিন পরেই চোখে পড়ল মহিলাকে। খুবই সুন্দরী। যদিও বয়সটা পন্চাশের ঘর পেরিয়েছে অনেক আগেই ,তা দেখলেই বোঝাই যায়। তবে পন্চাশের ঘরটা পেরিয়ে বয়সটা কতটুকু সামনে গিয়েছে তা বলা কঠিন। মহিলাকে আমার চোখে পড়ার ব্যাপারে আমার কোন কারসাজি নাই। কেননা আমার বয়স মাত্র পচিশ বছর। তাই আমার এই বয়সে, এত বয়স্ক মহিলার প্রতি কোন আগ্রহ থাকার কথা নয়। যেখানে প্রতিনিযত আশেপাশে ঘুরে বেড়াছ্ছে নজর কাড়া রুপসী উর্বশীরা।
আমি ছোটখাট একটা চায়ের দোকানে বসে চা খাছ্ছিলাম। মহিলা তার ছেলে পুত্র-বধু সহ হোটেলটার সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় আমাকে যেই না দেখলেন , সাথে সাথে হতচকিত হয়ে দাড়িয়ে গেলেন। আমার দিকে কিছুক্ষন হতবাক হয়ে তাকিয়ে থেকে দ্রুত নিজেকে সামলে নিলেন। তারপর চিন্তিত হয়ে মাথা নিচু করে কিছুদুর গিয়ে আবার ঘাড় ফিরিয়ে আমার দিকে তাকালেন।  ঘাড় ফিরিয়ে দেখতে দেখতে কিছুক্ষন পরে আবার মুখ ঘুরিয়ে চলে গেলেন। মহিলার আচরন দেখে আমি অবাক হয়ে গেলাম।
এরপরের দিন আমি হোটেলের সিড়ি দিয়ে যখন নামছি তখন দেখলাম মহিলা উপরে উঠছে। বুঝতে পারলাম আমি আর মহিলার পরিবার একই হোটেলে অবস্থান করছি। আমাকে দেখেই তিনি থমকে দাড়িয়ে গেলেন ! আমি কিছু না বলে মহিলাকে পাশ কাটিয়ে নেমে গেলাম। দৃষ্টি সীমার আড়াল হওয়ার আগে আমি কৌতুহল বশতঃ পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখতে পেলাম, মহিলা এক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
ব্যাপারটা আমাকে ভাবিয়ে তুলল। কে এই মহিলা ? মনেত হয় না, আমি কোথাও উনাকে দেখেছি। আমার চেনা জানা আত্মিয়ও নয়।  তাহলে….কে ইনি ?
এরপর দিনও দেখা হল। এবার আমি উপরে উঠছি, দেখি মহিলা দরজা খুলে দাড়িয়ে আছন। আমাকে দেখে দরজা থেকে আরেকটু বেরিয়ে এলেন। আমাকে বললেনঃ বাবা একটু দাড়াবে ? তোমার সাথে একটু কথা বলব।
এ কয়দিনে মহিলার অদ্ভুত আচরনে আমিও কৌতুহলী হয়ে উঠেছি, তাই দাড়িয়ে গেলাম।
ঃ তোমার নাম কি বাবা ?
আমি নাম বললাম।
ঃতোমার বাড়ি কোথায় ?
কেন জানি মহিলাকে আমার বাড়ির ঠিকানা বলতে ইছ্ছা হল না। তাই নানার বাড়ির ঠিকানা বললাম।
এরপর মহিলা বললঃ একটু ভিতরে এসে বসবে ? তোমার সাথে কিছুক্ষন কথা বলি।
আমি ভিতরে এসে বসলাম।
মহিলা আমার সামনে একটা টুল নিয়ে বসলেন।
ঃতুমি আমার ছেলের বয়সি হবে তাই বাবা বলে ডাকছি তুমি কিছু মনে করছনাত?
ঃ না আমি কিছু মনে করছি না। তবে আপনি আমাকে সালাম বলে ডাকুন । এটাই আমার ডাক নাম।
ঃতুমি হয়ত আমার এ কদিনের আচরনে অবাক হয়েছ তাইনা ?
ঃ হ্যা কিছুটা অবাক হয়েছি বটে। কিন্তু আপনার এ জাতীয় আচরনের কারণটা কি ?
মহিলা কিছুক্ষন চুপ থেকে নিজের আবেগকে সংযত করলেন । তবে পারলেন না , কেননা উনার শুকনো দুচোখ নোনা জলে ভিজে গেল।
ঃবাবা সালাম, আমি তোমাকে যখন প্রথম দেখি তখন ভীষন চমকে গিয়েছিলাম। কারন তোমার চেহারার সাথে আমার একজন প্রিয়, প্রিয় বললেও কম বলা হবে পরম প্রিয়জনের এতটা মিল যা আমাকে আবেগ প্রবন করে ফেলেছে।
আমি মনে মনে এটাই ধারনা করেছিলাম। মহিলা বলতে লাগলেন।
ঃ ওর নাম ছিল রুপম। আসল নামটা আমার মনে নাই কারন মনে রাখার চেষ্টা করিনি। এই নামের একটা ইতিহাস আছে। আমার নাম রুপা। আমার সাথে তার গভীর সখ্যতা দেখে আমার বাবা আমার রুপা নামের সাথে মিলিয়ে তার নাম দিয়েছেন রুপম। ওর বাবা ছিলেন সরকারী চাকুরে। তিনি যখন বদলী হয়ে আমাদের শহরে আসলেন এবং যেখানে বাসা নিলেন, তখন আমার বাবা ছিলেন ঐ এলাকার চেয়ারম্যান। রুপমের বাবা ছিলেন থানার ওসি। খুব সৎ লোক ছিলেন। উনি থানার ওসি হওয়ায় আমার বাবার সাথে সম্পর্কটা ছিল গভীর। রুপমের সাথে যখন আমার পরিচয় তখন সে পড়ত অষ্টম শ্রেণীতে আমি পড়তাম ষষ্ট শ্রেণীতে। আমাদের স্কুলে ছেলেমেযে একই সাথে পড়ত। তাই আমাদের দুই পরিবারের হূদয়তার কারনে আমি আর রুপম এক সাথে আসা যাওয়া করতাম। এই আসা-যাওয়ার মাঝে আমাদের পরস্পরের প্রতি ভালবাসা জন্ম নিল। তখন দুজন দুজনকে ছাড়া একদন্ডও থাকতে পারতাম না। একজন আরেকজনকে ভালবাসলে যা হয় আরকি। তোমাকে আর খুলে কি বলব। তুমিত যুবক তুমিও জান ভালবাসা কি জিনিস।
মহিলার ঠোটের কোনে এক চিলতে হাসি উকি দিয়ে হারিয়ে গেল। যেন বাদলা দিনে মেঘের আড়ালে সূর্য উকি দিল। এই বয়সেও মহিলার হাসিটা অপূর্ব। না জানি যৌবনে আরও কত সুন্দর ছিল। রুপমের ভাগ্য দেখে আমার একটু করে হিংসাই হল।
ঃআমাদের পরস্পরের প্রতি ভালবাসার কথা আমাদের পরিবারের লোকেরা জানত। এই ব্যাপারে দুজনের পরিবারের মৌন সম্মতি ছিল। তাই আমাদের মেলামেশাটা ছিল অবাধ এবং পবিত্র। একসময় রুপম কলেজে প্রবেশ করল। এই সময় আমার এক ফুপু বলেছিল আমাদের বিয়ের আকদটা করে ফেলতে। ফুপুর কথাটা দুই পরিবারে মানে নিয়ে এই ব্যাপারে আনেক দুর অগ্রসর হয়েও পরে ওর এক মামার অসম্মতির কারনে হয়নি। মামা যুক্তি ঠিক ছিল, এখন যদি আকদ হয়ে যায় তাহলে আমাদের দুজনের পড়ালেখার ক্ষতি হতে পারে। দুই পরিবারে যখন সম্মতি আছে তখন রুপমের পড়ালেখা শেষ হওয়ার পর আকদ ও উঠানো দুই একসাথে করা যাবে। হায়রে ভাগ্য তখন কি আমরা কেউ জানতাম আমাদের এই আশা আর কোনদিনও পুরন হবে না। এর কয়েক মাস পরই শুরু হল স্বাধীনতা সংগ্রাম। যদিও আমরা ঢাকা শহর থেকে দুরে তবুও আমাদের গ্রামে পাকিস্তানী সৈন্য আসতে বেশি সময় নিলনা। পকিস্তানীরা যেদিন এল সেদিন ওরা এলাকার গনমাণ্য সবাইকে নিয়ে মিটিং করল। মিটিং থেকে আমার বাবা ও রুপমের বাবা এক সাথে আমাদের বাসায় এলেন। আমার বাবা হাসিখুশি ছিলেন কিন্তু রুপমের বাবা ওসি সাহেব ছিলেন খুব গম্ভীর।
আমার এখনও মনে আছে বাবা রুপমের বাবার গম্ভীর মুখ দেখে বললেনঃ আরে এত চিন্তা করছেন কেন। মেজর খান সাহেব যা বলেছে খারাপ বলেনি। কথাটা সত্য কিছুদিনের মধ্যে সব স্বাভাবিক হয়ে যাবে। কেননা এই বিশাল বিশাল পাঠান সৈন্য আর অত্যাধুনিক অস্ত্রের কাছে দুর্বল বাংগালীরা বেশদিন টিকবে না। আপনি বাসায় যান দ্রূত শান্তি কমিটির লিষ্টটা করে ফেলেন। কাল সকালেই জমা দিতে হবে।
এরপর রুপমের বাবা চলে গেলেন। তার পরদিন সকালে এলাকায় খবর হয়ে গেল ওসি সাহেব পরিবার পরিজন নিয়ে পালি্যেছে। ওসি সাহেবের পালানোর খবর শুনে আমার বাবা বললেনঃ ওসি সাহেব কাজটা ঠিক করেননি। নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মেরেছে। কিছুদিনের ভিতর সব কিছু স্বাভাবিক হয়ে এলে পাকিস্তানী সরকার ওদের খুজে বের করে মারবে।
সেই যে গেল আর কোনদিনও রুপমরা আর এল না। যুদ্ধের সময় বাবার মুখে শুনেছিলাম রুপম আর রুপমের বাবা দুজনেই মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছে।(মহিলা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।) এরপর আর কোনদিনও রুপমের সাথে আমার দেখা হয়নি। হয়ত যুদ্ধে মারা গেছে। তা নাহলে আমাদের যে গভীর প্রেম ছিল ও একদিন না একদিন অবশ্যই আমার কাছে আসত।
মহিলার দুচোখ বেয়ে অঝোর ধারায় অশ্রূ গড়িয়ে পড়ছে। আমার মনটা খারাপ হয়ে গেল। আমি কি বলে উনাকে স্বান্তনা দেব বুঝে উঠতে পারছিলাম না। মাথা নিচু করে চুপ করে বসে রইলাম। কিছুক্ষণ পর মহিলা নিজেকে সংযত করে নিলেন।
ঃবাবা তোমার চেহারার সাথে সেই রুপমের চেহারার এতটা মিল যে হয়ত তোমাকে দেখলে ওর মাও মনে করবে তুমি উনার ছেলে রুপম।
মহিলা আবার মিষ্টি করে একটা হাসি দিল। অপূর্ব হাসি।
ঃতুমি একদিন ঢাকায় আমার বাসায় এস। রুপমের ছবি তোমায় দেখাব। ওর আর আমার কয়েকটা পারিবারিক আমার কাছে এখনও ছবি আছে। তুমি আসলে খুশি হব।
আমার খুব কৌতুহল জাগল ছবিটা দেখার তাই বাসার ঠিকানাটা নিলাম।
কক্সবাজার থেকে ঢাকায় ফেরার কয়েকদিন পরই মহিলার বাসায় গেলাম। বিশাল জায়গার উপর আলীশান এক বাড়ি। মহিলা আমাকে দেখেই আনণ্দে আবেগ আপ্লুত। তিনি বলেই ফেললেনঃ তোমাকে দেখে মনে হছ্ছে আমার সেই রুপম যেন এসেছে।
আমি মহিলার আবেগ দেখে নিজেও কিছুটা বিব্রত হয়ে পড়লাম। মহিলা আমার বিব্রত অবস্থা বুঝতে পেরে নিজেকে সামলে নিলেন। এস বাবা এস আমার আচরণে কিছু মনে কর না। তোমাকে দেখে আমি কিছুটা নিয়ন্ত্রন হীন হয়ে পড়েছিলাম। আমি দুঃখিত।
ঃ না না আপনার আচরণে আমি কিছু মনে করি নি। এমন হওয়াটা স্বাভাবিক। আপনার জীবনের প্রথম প্রেম। প্রত্যেক মানুষ তার জীবনের প্রথম প্রেমকে কখনও ভুলতে পারে না।
মহিলা মাথা ঝাকিয়ে বললঃ ঠিক বলেছ আমি এখনও রুপমকে ভুলতে পারিনি। আর কখনও পারবোও না।
উনি এ্যালবাম বের করলেন। কয়েক পৃষ্ঠা উল্টানোর পর একটা পৃষ্ঠায় অনেক পুরানো কয়েকটা পারিবরিক ছবি দেখা গেল। মহিলা আমাকে দেখিয়ে দেওয়ার আগেই আমি দেখতে পেলাম হুবহু আমারই মত একজন দাড়িয়ে আছে এক তরুনীর পাশে।
আমি চমকে উঠলাম, আমার সারা শরীর কেপে উঠল। মহিলা আমার আচরন দেখতে পেয়ে বললঃ বাবা তোমার কি শরীর খারাপ লাগছে ?
আমি কিছুই বললাম না।
সেদিন রাতেই বাবার রুমে গেলাম। বৃদ্ধ বাবা নানা রোগে জর্জরিত। তবে এখনও সোজা হয়ে হাটেন। ন্যায়ের ব্যাপারে চরম কঠোর ও আপোষহীন। আমার বাবা আমার কাছে দ্বীতিয় আদর্শ , প্রথম আদর্শ নবী মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাল্লাম। এমন বাবার সন্তান হতে পেরে আমি নিজে গর্ব বোধ করি।
তিনি টেবিলে বসে বই পড়ছিলেন। আমাকে ঢুকতে দেখে কিছুটা অবাক। আমি আরেকটা চেয়ার টেনে বাবার পাশে বসলাম।
ঃকিছু বলবি ?
আমি জানি আমার বাবা মুক্তিযোদ্ধা। আমার দাদা ওসি সাহেব তিনিও মুক্তিযোদ্ধা তবে তিনি শহীদ হয়েছেন। কিন্তু বাবা যে এতবড় আত্মত্যাগী তা আমার জানা ছিল না। কিন্তু কেন ? কি কারনে এই আত্মত্যাগ তা আমাকে জানতে হবে।
ঃবাবা আপনাকে একটা প্রশ্ন করব উত্তর দেবেন ?
ঃবল।
ঃআপনি রূপম নামে কাউকে চেনেন ?
বাবা এমন ভাবে চমকে উঠলেন যে যেন ঘুমন্ত মানুষ হটাৎ জেগে উঠল। বাবার কন্ঠ ভারী হয়ে গেল। আবেগে নয় রাগে।
ঃতুই এই নাম কোথায় পেলি।
আমি কিছু না বলে চুপ করে রইলাম।
ঃআমি এই নামকে কবর দিয়েছি আজ থেকে চল্লিশ বছর আগে। শুধু নাম নয় ওই নামের মানুষটাকেও কবর দিয়েছি। এই ব্যাপারে আমি আমার মা আর বাবা ছাড়া কেউ জানত না। আমি ছাড়া আর দুজনত আজ এই দুনিয়ায় নাই। তারপরও ঘটনাটা তুই জানলি কি করে ?
আমি ঘটনাটা বললাম। বাবা মন দিয়ে সম্পূর্নটা শুনে বললেনঃ তুই রুপার কাছে তোর পরিচয় প্রকাশ করেছিস ?
ঃ না বাবা আমি পরিচয় প্রকাশ করিনি।
ঃ ঐ অতীতকে আমি আর কখনো সামনে আনতে চাই না। কারন ঐ অতীত আমার কাছে কালো একটা অধ্যায়।
ঃ ওনার অপরাধ কি ছিল….।
বাবা আমার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বললেনঃ ওর বাবা ছিল রাজাকার। ওর দেহে আছে রাজাকারের নাপাক রক্ত। এই হল রূপার অপরাধ।

লেখক সম্পর্কে জানুন |
সর্বমোট পোস্ট: ০ টি
সর্বমোট মন্তব্য: ১ টি
নিবন্ধন করেছেন: মিনিটে

মন্তব্য করুন

go_top