উপন্যাস “প্রচ্ছায়া”
ছোট বেলায় মিজানের ক্রিকেট খেলার প্রতি খুব ঝোঁক ছিল । ঢের চেষ্টা সত্ত্বেও ভালো খেলোয়ার হতে পারে নি । বোলিং করতে দিলে এক ওভারে একাধিক ওয়াইড ও নো-বল । ব্যাটিং করতে গেলে দুই ওভারের বেশি ক্রিজে টিকতে পারে না । যে সকল ম্যাচে ব্যাটিং-এর সুযোগ পেয়েছে প্রায় তার সবগুলোতেই শূন্য রানে আউট হতে হয়েছে ।
তবে ব্যাটিং আর বোলিং-এর চেয়ে ফিল্ডিং-এ মোটামোটি পারদর্শী ছিল বলে স্কুলের ছেলেপুলেরা ইচ্ছের বিরুদ্ধেই মিজানকে খেলায় নামাতো । কিন্তু আশেপাশে ভালো কেউ থাকলে পরে মিজানকে বাদ দিয়েই টিম গঠনের প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যেত । সেই ক্ষেত্রে নিরুপায় মিজান ভলান্টিয়ার, আম্পিয়ার বা দর্শকের ভূমিকা পালন করতো । মিজানের অনেক খায়েস ছিল একদিন না একদিন ছক্কা হাকাবে । তারপর বাকী জীবনে আর খেলতে না পরলেও আফসোস নেই । কিন্তু কীভাবে ছক্কা হাকাবে তা বুঝতে পারে না । এই পর্যন্ত একটি চারও মারতে পারে নি যে । মিজান ক্রিজে থাকলে বরাবরই একটি ব্যাপার ঘটে, বোলারের বল ওর দিকে আসতে দেখলেই ভেতর শুকিয়ে যায়, ভয়ে পা কাঁপোনি শুরু হয়ে যায় । তাই তো বলের গতি আঁচ করতে পারে না । আর সেই জন্যেই ব্যাটে বলে এক করতে পেরেছে খুব কম ।
একবার ওদের স্কুলের ছেলেরা স্যারদেরকে না জানিয়েই অন্য স্কুলের সাথে খেলা রেখে ছিল । খেলার আগের দিন মিজানদের দলের একজন নির্ভরযোগ্য ব্যাটসম্যান হঠাত্ ইঞ্জুরীর শিকার হলে দল খেলোয়ার সংকটে পড়ে । সেই খেলায় মিজানের উপর ভলান্টিয়ারের দায়িত্ব ছিল । এ দায়িত্ব অবশ্য কাগজে কলমে লেখে বা মাইকিং করে ওকে দিতে হয় না । ক্রিকেটের প্রতি ভালোবাসা থেকেই মিজান বরাবর-ই দলের সঙ্গে যুক্ত থাকতে চায় । আর দলের সাথে থাকতে হলে তাকে বাধ্য হয়ে বিরক্তিকর এই দায়িত্বটি পালন করতে হয় । হঠাত খেলোয়ার সংকট হওয়ায় টিম-ক্যাপ্টেন উপায়োন্ত না দেখে অবশেষে মিজানকে টিমে অন্তর্ভূক্ত করলেন । টস হেরে মিজানরা আগে বোলিং করল । ব্যাটিং করতে নেমে মিজানদের দলের উদ্ভোদনী দুই ব্যাটসম্যান শুরুর দিকে ভালোই করছিল । মিজান তখনি আশা ছেড়ে দিয়ে ছিল আজ ব্যাটিং করতে পারবে বলে । ত্রিশ ওভার খেলার পর ঐ দুইজনের ওইকেট পতন হওয়ার পর খেলা মোড় ঘুরে যায় । তারপর নিয়েমিত বিরতিতে ওইকেট পড়তে থাকায় দল চাপে পড়ে । শেষ পাঁচ বল বাকী থাকতে সর্বশেষ ওইকেট মিজান ক্রিজে নামল । জয়ের জন্য তখন এগারো রান দরকার । মিজান নেমেই এক খেয়ে ফেলায় চার বলে এগারো রানের প্রয়োজন হয়ে দাড়াল । সহকারী ব্যাটসম্যান খুব আকুতি মিনতি করছে, যেভাবোই হোক এক রান নিয়ে ক্রিজ ছাড়ার জন্য । দ্বিতীয় বল আসার আগেই মিজান প্রাণপণ প্রস্তুতি নিলো, যেভাবেই হোক এই বলে অন্তত এক রান হলেও নিতে হবে । বল আসতেই মিজান কোনো রকমে ব্যাটে বলে করে ঝেড়ে দৌড় দিলো । তৃতীয় বলে সহকারী ব্যাটসম্যান চার মারল । এখন দুই বলে ছয় রানে দরকার । চতুর্থ বলে এক রান নিতে গিয়ে সহকারী ব্যাটসম্যানকে বাধ্য হয়ে ক্রিজ ছাড়তে হল । এখন এক বলে পাঁচ রানের অত্যাবশ্যকতা হয়ে দাড়াল । ক্রিজে আছে মিজান । মিজানদের দলের সবাই হাল ছেড়ে দিলো । যে মিজান জীবনে কখনো টোটাল চার করতে পারে নি সেই মিজান এক বলে পাঁচ রান বা ছক্কা মারবে এটা অসম্ভব ! যখন বল আসল, মিজান সেই অসম্ভব কাজটিই করে দেখাল । মিজানকে নিয়ে মাতামাতি আর নাচানাচির অন্ত রইলো না । দলের সবচেয়ে নিকৃষ্ট খেলোয়ারই দলকে জিতিয়ে দিলো ! সেই যে মিজান খেলা ছেড়েছে, আর কোনো দিন খেলতে নামে নি । বিশ্বকাপ বা তার চেয়েও যদি বড় কোনো খেলা হয়, মিজান মাঠে গিয়ে দেখা তো দূরের কথা, টেলিভিশনের পর্দায়ও দৃষ্টি দেয় না । এটা ক্রিকেটের প্রতি তার ক্ষোভ না আত্মতুষ্টি ঠিক বুঝা গেল না ।
মিজানদের একটি করলা গাড়ী আছে । গত বছর গাড়ীটি নতুন কেনা হয়েছে । মিজানের বাবা মশিউর সাহেব বিদেশ চলে যাবার পর থেকে গাড়ীটি পড়েই ছিল । মিজান খুব ভালো গাড়ী চালাতে পারে । গত কয়েক দিন ধরে মিজান রাত বারোটার পর নিয়মিত গাড়ী নিয়ে বের হয় । প্রথমে যায় সংসদভবণ এলাকায়, সংসদভবণ এলাকায় খানিকক্ষণ সময় কাটানোর পর সেখান থেকে কোনোদিন যায় সদরঘাট, কোনোদিন নিউমার্কেট, আবার কোনো দিন শহরের সব জঞ্জলাকে পেছনে ফেলে চলে যায় আশুলিয়ায় ।