ধারাবাহিক উপন্যাস “নিয়োগ পত্র” ষষ্ঠ পর্ব
ষষ্ঠ পর্ব
(সাত)
তিমিরের আর কোথাও যাবার ইচ্ছা নেই।
হাত ঘড়িটা দেখে নেয়। রাত আটটা। আধা ঘন্টা লেট। সাড়ে সাতটায় চকবাজারের টিউশনিটা। যাবে কিনা ভাবছে। যাওয়াটা উচিত। সামনে ফাইনাল পরীক্ষা। এই সময়টা ছাত্রদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
তিমির চকবাজারের সামনে এসে দাঁড়ায়। একজন লোক পিছন থেকে ছুটে আসে। একবারে তিমিরের সামনে এসে দাঁড়ায়। হাত তুলে ভদ্রভাবে সালাম জানায়। তিমির বিব্রত বোধ করে। চিনতে পারে না। বয়সটা মাঝারী। পরনে ময়লা শার্ট আর সাদা লুঙ্গি। ভেবে চিন্তে মনে করার চেষ্টা করে। মনে পরছে না। হালকা ছিপছিপে গড়ন। লোকটির চোখে মুখে কৃতজ্ঞতার ছাপ। নিজে থেকে বলল- ভাইজান, আমারে চিনতে পারলেন না। আমি সিরাজ মিয়া। ঐ যে আমারে চিটি লেইখ্যা দিছিলেন। ভালোবাসার চিঠি।
একটু লজ্জিত হয় সিরাজ মিয়া। যেন আরও কিছু বলতে চায়। মনের পাতায় সহসা উঠে আসছে না সিরাজ মিয়াকে। না ভেবেই জবাব দেয়-ও আচ্ছা। মনে পরেছে। কেমন আছেন।
– ভালা আছি। আপনের দেহা পায় নাই। অনেক খুঁজছি। জানেন ভাইজান-মাছুমার লগে আমার বিয়া হইছে। এইত গত ফাওন মাসে।
– কোন মেয়েটা।
– ঐ যে, আপনে হেই পরতম চিডি লেইখ্যা দিছিলেন। আমার মাছুমার জন্য। কি আর বলব, আপনার হাতে কি একখান যাদু আছে। মাছুমা আমারে পাগলের মত ভালোবাসত।
তিমিরের মনে পরে। বাস কণ্ট্রাকটর সিরাজ মিয়া। লেখাপড়া জানে না। একটা মেয়েকে ভালোবেসেছিল। সে বছর দু’য়েক আগের কথা। সিরাজ মিয়ার ফুফুর বাসায় একদিন পরিচয়। সিরাজের ফুফাতো ভাইদের পড়াত তিমির। প্রথম বার পরিচয়ের পর সিরাজ মিয়া আমতা আমতা করে কি যেন বলতে চেয়েছিল। সাহস করে বলতে পারে নি। তার ক’দিন পরে এসে সাহস করে বলেই ফেলল-
– ভাইজান আমারে এখখান চিডি লেইখ্যা দিবেন।
– কার চিটি।
সিরাজ মিয়া লজ্জা পায়।
– হেইডা পরে কমু।
তিমির বুঝতে পারে। কৌতুহল হয়। একটু সহজ ভাবে বলে-ভালোবাসার চিটি বুঝি? সিরাজ মিয়া মাথা নীচু করে হ বলল। তিমির হাসল। তারপর বলল-কি নাম।
– মাছুমা খাতুন।
– বাড়ী কোথায়।
– আমাগো গেরামে।
– আচ্ছা একসময় লিখে দেব। বলে টিউশানি শেষ করে তিমির চলে আসছিল। সিরাজ মিয়াও পিছু পিছু আসছে। তিমির বারণ করেনি। সোজা তিমিরের বাসায় চলে এসেছে সিরাজ মিয়া। তিমির সিরাজকে চৌকিতে বসতে বলে নিজে পাশে বসল।
– খুব ভালোবাস বুঝি।
– হ ভাইজান। অরে ছাড়া আমি বাচুম না।
– তোমার মা বাবা।
– সবার তো মা বাবা থাহে না। আমারও নাই।
– মারা গেছে।
– না।
– তাহলে।
– বাবায় রিক্সা চালাইত। মারে রাইখ্যা আর এখখান বিয়া করছে। পরে জানাজানি হওনের পর দিছে তালাক। তহন আমার বয়স সাত। আমার বইনের বয়স চাইর বছর। মার লগে কিছুদিন থাহনের পর মা’য়ও আরেকজনরে বিয়া বইছে।
– তারপর।
তিমিরের মায়া হল। মাছুমার কথা মনে হল। মনে মনে হাসিও পেল। হাসি সংবরণ করল তিমির। বড় অদ্ভুদ লোকটি। কোন ভাবান্তর নেয়। কথাগুলো কত সহজ সরল ভাবে বলে যাচ্ছে। সিরাজ মিয়া যে মাছুমাকে ভালোবাসে সেটা তার চেহারায় স্পষ্ট ফুটে উঠেছে।
– তারপর আর কি। মায়ের লগে আমরা ভাইবোন কিছুদিন ভালোই ছিলাম। নতুন বাপেরে আব্বা কইতাম না বলে চড় থাপ্পর দিত। তাও সহ্য করছিলাম। একদিন একটা প্লেইট ভাঙ্গছে বলে আমার বইনটিরে খুব মারল। আমি ধরবার লাইগ্যা গেছি। আমারেও খুব মারলো। আমার মাও চুপচাপ। কিচ্ছু কইলো না। জ্বরে বইনটা মরতে বসছিলো। একটু ঔষুধ পর্যন্ত খাওযাইলো না। হে যাত্রায় কোন ভাবে বইনটারে লইয়া ফুফুর বাসায় আশ্রয় লইছি।
– হনুফা বুঝি তোমার বোন।
– হ’ ভাইজান।
– ও খুব ভালো মেয়ে।
– হ’ ভাইজান।
তিমির ডায়েরীর ভিতর থেকে দু’টো পাতা ছিঁড়ে জিজ্ঞাসা করল-
– কি লিখতে হবে বলো।
– আমি কি কমু ভাইজান। আপনে ভালোমতন সুন্দর ভাষা দিয়া একখান চিডি লেইখ্যা দেন। এইডা আমার পরতম চিডি। আপনেরা লেহাপড়া জানা মানুষ। আপনেগো কলমে কত ভাষা। আমি কিছু কইবার পারুম না। তয় চিডির শেষের দিকে কয়ডা শোলক লেইখ্যা দিয়েন।
– আমি যে শ্লোক জানি না।
– হেইডা আমি কইয়া দিমুনে।
– আচ্ছা ঠিক আছে। মাছুমা পড়তো পারে তো।
– হ’ ভাইজান। পারে। কেলাস ফাইভ পর্যন্ত পড়ছে।
সেদিন চার পৃষ্টার একটা চিটি লিখে দিয়েছিল তিমির। নিজের জীবনে এতবড় চিটি কখনও লিখে নাই। লিখার প্রয়োজন হয়নি। চিটিটা লিখে সন্দেহ হয়েছিল সিরাজ মিয়ার ভালোবাসাকে সে যেভাবে বর্ননা করেছে সিরাজ মিয়ার জীবনে তার কতটুকু সত্যতা আছে। কিংবা মাছুমা আদৌ সিরাজ মিয়াকে ভালোবাসে কিনা। তা জিজ্ঞাসা করা হয়নি। ভালো না বাসলেও এ চিটি পেয়ে মেয়েটির মন নরম হতে পারে। ভালোবাসতেও পারে।
চিটি লিখা শেষ। সিরাজ মিয়ার চোখে মুখে আনন্দের ছাপ। এক অবর্ননীয় আনন্দ খেলা করছে। সামান্য একটা চিটি লিখে মানুষ এত খুশী হতে পারে কি করে। তিমির এতটা ভাবতে পারছে না। মনে হচ্ছে সে যা লিখেছে তা চৈতীর কাছে লিখলেই ভালো হতো। চৈতীর কাছে কখনও এত দীর্ঘ চিঠি লেখা হয়নি। একবার ভাবল দুই কপি করে একটা চৈতীর কাছে পাঠালে কেমন হয়। শ্লোক গুলো এখনও লেখা হয়নি। শ্লোক লিখে দিলে চৈতী খুব হাসবে। মজা করবে। মাছুমার কাছে লিখতে গিয়ে সে যেন নিজের কথায় ছাপিয়ে দিয়েছে। তাতে সিরাজ মিয়ার কোন সামঞ্জস্য নেয়। অবশ্য পৃথিবীর সব ভালোবাসার সুখ দুঃখের অনুভূতিগুলো তো একই। ভালোবাসার কাছে সিরাজ মিয়া আর তিমির কিংবা চৈতী বা মাছুমার কোন পার্থক্য নেই। সবশেষে লিখল আমি আজীবন তোমার প্রতিক্ষায় বেঁচে থাকবো। ইতি তোমারই সিরাজ।
তিমির লেখা শেষ করে বলল-
– বুঝলে সিরাজ মিয়া-এ পৃথিবীতে কে কার সেটায় বুঝা বড় মুশকিল।
– ঠিক কইছেন ভাইজান। মায়া মানুষের মন হইলো কচু পাতার পানির লাহান। তয় ভাইজান, মাছুমা খুব ভালা মায়া। আমারে কথা দিছে, আমারে ছাড়া আর কাউরে হে বিয়া করবে না।
– এবার তোমার শ্লোক বলো।
কাগজের শেষের পৃষ্টায় একটু খানি জায়গা খালি আছে। সিরাজ চোখ ঘুরিয়ে একবার দেখে নেয়। তারপর জিজ্ঞাসা করে-
– শোলকের জায়গা হইবো।
– হবে হবে। নয়তো আলাদা কাগজে লিখে দেব।
সিরাজ মিয়া লজ্জা পায়। বলতে পারছে না। তিমির তাগাদা দেয়-তাড়া তাড়ি বলো।
– ভাইজান আমার শরম করে।
– শরমের কিছু নাই। তুমি বলো।
– আইচ্ছ্যা লিখেন-
তেতুল পাতা তেতুল পাতা, তেতুল বড় টক,
তোমার সনে ভাব করিতে আমার বড় সখ।
তিমির লিখে একটু হাসল। একবার ভাবল-ভালোবাসার জন্য মানুষ কত নির্লজ্জ হতে পারে। বলল-আরো জায়গা আছে। এবার দ্বীতিয় শ্লোকটি বল। সিরাজ মিয়া দ্বীতিয় শ্লোকটি বলল-
কথায় কথায় মিষ্টি হাসি
আমি তোমায় ভালোবাসি,
পায় যদি গো ভালোবাসা
সুখের লাগি বাঁধবো বাসা।
এই শ্লোকটার মধ্যে এক ধরনের কবি কবি ভাব। জিজ্ঞাসা করল- কে বানিয়েছে।
– আমি ভাইজান। আরও কত কথা মনে পরে। বেবাক কথা মনে থাহে না। বুঝলেন ভাইজান। অহন মনে হইতাছে লেহাপড়া না শিখা জীবনে কত বড় ভুল করছি।
তিমির চিঠিটা হাতে দিতেই আর একবার হাসল সিরাজ মিয়া। সে হাসি গর্বের, আনন্দের, আত্মতৃপ্তির। এই মুহুর্তে সে ভালোবাসার পরিপূর্ণতা পেয়েছে। চিঠিটা খুব যতেরœ সাথে ভাঁজ করে পকেটে নিল। তারপর বুক পকেট থেকে পঞ্চাশ টাকার একটা নোট বের করে তিমিরের হাতে দিয়ে বলল-ভাইজান কিছু মনে কইরেন না। আপনে একটু চা পানি খাইয়েন।
তিমির খুব লজ্জা পেল। রাগে সারা শরীর ঘিন ঘিন করছে। পরক্ষনে শান্ত হয়ে ভাবল সিরাজ মিয়া হয়তো আমাকে ওর মত করে ভেবেছে। সে আমাকে ছোট করেনি। অপমান করেনি। আমার লেখাপড়ার মূল্য দিতে চেয়েছে। তাছাড়া পেশা হিসাবে তো মন্দ না। দু’চার পাতা লিখে দিয়ে কেমন কড়কড়ে একটা পঞ্চাশ টাকার নোট। এরকম কয়েকজন কাষ্টমার পেলে পরিচিতি পেতে বেশীদিন লাগবে না। দিনে আট দশটা চিঠি লিখতে পারলে হবে। কিন্তু আপাততঃ এ টাকা নেওয়া যাবে না। তিমির টাকাটা সিরাজের বুক পকেটে দিয়ে বলল-এটা তোমার কাছে রাখ। তোমাদের বিয়ের সময় মিষ্টি খাওয়াবে। তাতেই আমি খুশী। তারপরও সিরাজ মিয়া নাছোড় বান্দা। অনেকটা জোড় করে চায়ের দোকানে নিয়ে গেল। চা খাওয়াল। চা খেতে খেতে তিমির জিজ্ঞাসা করল-কিভাবে পাঠাবে।
– ডাকে দিতে ভয় লাগে। সামনের শনিবারে বাড়ী যামু। একটা শাড়ীও কিনছি। বাড়ী গেলে হাতে হাতে দিয়া দিমুনে।
তার কিছুদিন পর আবার হাজির হয় সিরাজ মিয়া। তিমির ঘর থেকে বেরুতে যাচ্ছিল। সিরাজকে দেখে হাসিমুখে জিজ্ঞাসা করল-কি খবর। মাছুমার চিঠি পেয়েছো।
সিরাজের মুখখানা হাসি হাসি। এখন আর আগের মত লজ্জা নেই। অনেকটা সহজ হতে পেরেছে।
– হ’ ভাইজান। আপনের লেখা চিঠি পাইয়া হে তো দিশাহারা হইয়া গেছে। এই দ্যাহেন বলে সিরাজ বুক পকেট থেকে একটা চিটি বের করে দেয়।
বাংলা রোল কাগজে লেখা। বড় বড় অক্ষর। অনেকগুলো বানান ভুল। পড়তে কষ্ট হচ্ছিল। কিন্তু চিটির ভাষা বুঝতে মোটেও কষ্ট হচ্ছিল না। চিটিতে অনেকগুলো শ্লোক। তবুও কৌতুহল নিয়ে দেখছে চিটিটা। মাছুমা লিখেছে-ওগো তুমি আমার আদার (আঁধার) রাইতের তারা। নিসিত (নিশিত) রাইতে আমি তোমারে সপন (স্বপন) দেহি। তোমারে কেমন করিয়া ভুলিব। তোমার চিটি পরিয়া (পড়িয়া) আমি পাগলনি (পাগলিনী) হইয়াছি। ইতি তোমার জানের জান-মাছুমা।
তিমির না হেসে পারল না। চিটিটা সিরাজের হাতে দিয়ে বলল-ভালোই লিখেছে। মাছুমা সত্যিই তোমাকে খুব ভালোবাসে। তুমি মাছুমাকে কখনও কষ্ট দিও না।
– ভাইজান এই চিটির উত্তরটা একটু লেইখ্যা দিবেন না।
– আজ যে আমার একটু তাড়া আছে। কাজে যাচ্ছি। আরেকদিন লিখে দেব।
তিমির ঘর থেকে বেরিয়ে যেতেই সিরাজ মিয়া বলল-আইচ্ছা, কাল সন্ধ্যায় আসব।
– ঠিক আছে । পরের দিন সন্ধ্যায় এসে আবারও চিটির উত্তরটা লিখিয়ে নিয়েছিল সিরাজ মিয়া।
সেই সিরাজ মিয়াকে এতদিন পরে চিনতে পারার কথা নয়। স্বাস্থ্য ভেঙ্গে পরেছে। রোগা রোগা চেহারা। চোখ দু’টো কেমন যেন নিস্তেজ। ঘোলাটে দৃষ্টি। আজ তিমিরের তাড়া দেখেও সিরাজ মিয়া পথ ছাড়ল না। জোড় করে পাশের চায়ের দোকান বসিয়ে বলল-ভাইজান আপনের লগে অনেক কথা আছে।
– কিন্তু আমার যে সময় নেই।
সিরাজ কোন অজুহাত শুনল না। হাত ধরে ফেলল তিমিরের। না গিয়ে উপায় নেই। চায়ে চুমুক দিয়ে তিমির জিজ্ঞাসা করলÑ কি কথা বল।
– ভাইজান আমরা পলাইয়া বিয়া করছিলাম। মাছুমার বাবা পরথমে রাজী হয় নাই, বিয়ার এক বছর পর আস্তে আস্তে মাইনা লইছে। আরো অনেক কথা বলতে চাইছে। এত কথা শুনার মত ধের্য্য তিমিরের নাই। যতই সিরাজ মিয়ার কথা শুনছিল বার বার চৈতীর কথা মনে হচ্ছে।
চলবে……