Today 11 Oct 2025
Top today
Welcome to cholontika

শেষের কবিতা, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, অধ্যায় ১৬ (মুক্তি)

: | : ২৬/০৯/২০১৩

একটি ছোটো চিঠি এল লাবণ্যের হাতে, শোভনলালের লেখা- শিলঙ কাল রাত্রে এসেছি। যদি দেখা করতে অনুমতি দাও তবে দেখতে যাব। না যদি দাও কালই ফিরব। তোমার কাছে শাসি- পেয়েছি, কিন’ কবে কী অপরাধ করেছি আজ পর্যন- স্পষ্ট করে বুঝতে পারি নি। আজ এসছি তোমার কাছে সেই কথাটি শোনবার জন্যে, নইলে মনে শানি- পাই নে। ভয় কোরো না। আমার আর-কোনো প্রার্থনা নেই।

লাবণ্যর চোখে জলে ভরে এল। মুছে ফেললে; চুপ করে বসে ফিরে তাকিয়ে রইল নিজের অতীতের দিকে। যে অঙ্কুরটা বড়ো হয়ে উঠতে পারত, অথচ যেটাকে চেপে দিয়েছে, বাড়তে দেয় নি, তার সেই কচিবেলাকার করুণ ভীরুতা ওর মনে এল। এতদিনে সে ওর সমস- জীবনকে অধিকার করে তাকে সফল করতে পারত। কিন’ সেদিন ওর ছিল জ্ঞানের গর্ব, বিদ্যার একনিষ্ঠ সাধনা, উদ্ধত স্বতন্ত্র্যবোধ। সেদিন আপন বাপের মুগ্ধতা দেখে ভালোবাসাকে দুর্বলতা বলে মনে মনে ধিককার দিয়েছে। ভালোবাসা আজ তার শোধ নিলে, অভিমান হল ধুলিসাৎ। সেদিন যা সহজে হতে পারত নিশ্বাসের মতো, সরল হাসির মতো, আজ তা কঠিন হয়ে উঠল; সেদিনকার জীবনের সেই অতিথিকে দু হাত বাড়িয়ে গ্রহণ করতে আজ বাধা পড়ে, তাকে ত্যাগ করতে বুক ফেটে যায়। মনে পড়ল অপমানিত শোভনলালের সেই কুন্ঠিত ব্যথিত মুর্তি। তার পরে কতদিন গেছে, যুবকের সেই প্রত্যাখাত ভালোবাসা এতদিন কোন্‌ অমৃতে বেঁচে রইল? আপনারই আন-রিক মাহাত্ন্যে। লাবণ্য চিঠিতে লিখলে- তুমি আমার সকলের বড়ো বন্ধু। এ বন্ধুত্বের দাম দিতে পারি এমন ধন আজ আমার হাতে নেই। তুমি কোনোদিন দাম চাও নি; আজও তোমার যা দেবার জিনিস তাই দিতে এসেছ কিছুই দাবি না করে! চাই নে বলে ফিরিয়ে দিতে পারি এমন শক্তি নেই আমার, এমন অহংকারও নেই। চিঠিটা লিখে পাঠিয়ে দিয়েছে এমন সময় অমিত এসে বললে, ‘ বন্যা, চলো আজ দুজনে একবার বেড়িয়ে আসি গে।’ অমিত ভয়ে-ভয়েই বলেছিল; ভেবেছিল লাবণ্য আজ হয়তো যেতে রাজি হবে না। লাবণ্য সহজেই বললে, ‘ চলো।’ দুজনে বেরোল। অমিত কিছু দ্বিধার সঙ্গেই লাবণ্যর হাতটিকে হাতের মধ্যে নেবার চেষ্টা করলে। লাবণ্য একটুও বাধা না দিয়ে হাত ধরতে দিলে। অমিত হাতটি একটু জোরে চেপে ধরলে, তাতেই মনের কথা যেটুকু ব্যক্ত হয় তার বেশি কিছু মুখে এল না। চলতে চলতে সেদিনকার সেই জায়গাতে এল যেখানে বনের মধ্যে হঠাৎ একটুখানি ফাঁক। একটি তরুশূন্য পাহাড়ের শিখরের উপর সূর্য আপনার শেষ স্পর্শ ঠেকিয়ে নেমে গেল। অতি সুকুমার সবুজের আভা আসে- আসে- সুকোমল নীলে গেল মিলিয়ে। দুজনে থেমে সে দিকে মুখ করে দাড়িয়ে রইল। লাবণ্য আসে- আসে- বললে, ‘ একদিন একজনকে যে আংটি পরিয়েছিল, আমাকে দিয়ে আজ সে আংটি খোলালে কেন?’ অমিত ব্যথিত হয়ে বললে, ‘ তোমাকে সব কথা বোঝার কেমন করে বন্যা? সেদিন যাকে আংটি পরিয়েছিলুম আর যে আজ সেটা খুলে দিলে তারা দুজনে কি একই মানুষ? লাবণ্য বললে, ‘ তাদের মধ্যে একজন সৃষ্টিকর্তার আদরে তৈরি, আর-একজন তোমার অনাদরে গড়া।’ অমিত বললে, কথাটা সম্পূর্ণ ঠিক নয়। যে আঘাতে আজকের কেটি তৈরি, তার দায়িত্ব কেবল আমার একলার নয়।’ ‘ কিন’ মিতা, নিজেকে যে একদিন সম্পূর্ণ তোমার হাতে উৎসর্গ করেছিল তাকে তুমি আপনার করে রাখলে না কেন? যে কারণেই হোক, আগে তোমার মুঠো আলগা হয়েছে, তার পরে দশের মুঠোর চাপ পড়েছে ওর উপরে, ওর মুর্তি গেছে বদলে। তোমার মন একদিন হারিয়েছে বলেই দশের মনের মতো করে নিজেকে সাজাতে বসল। আজ তো দেখি ও বিলিতি দোকানের পুতুলের মতো; সেটা সম্ভব হত না যদি ওর হৃদয় বেঁচে থাকত। থাক গে ও সব কথা। তোমার কাছে আমার একটা প্রার্থনা আছে। রাখতে হবে।’ ‘বলো, নিশ্চয় রাখব।’ ‘ অন-ত হপ্তাখানকের জন্যে তোমার দলকে নিয়ে তুমি চেরাপুঞ্জিতে বেরিয়ে এসো। ওকে আনন্দ দিতে নাও যদি পারো, ওকে আমোদ দিতে পারবে।’ অমিত একটুখানি চুপ করে থেকে বললে, ‘ আচ্ছা।’ তার পরে লাবণ্য অমিতর বুকে মাথা রেখে বললে, একটা কথা তোমাকে বলি মিতা, আর কোনোদিন বলব না। তোমার সঙ্গে আমার যে সম্বন্ধ তা নিয়ে তোমার লেশমাত্র দায় নেই। আমি রাগ করে বলছি নে, আমার সমস- ভালোবাসা দিয়েই বলছি, আমাকে তুমি আংটি দিয়ো না, কোনো চিহ্ন রাখবার কিছু দরকার নেই। আমার প্রেম থাক্‌ নিরঞ্জন বাইরের রেখা, বাইরের ছায়া তাতে পড়বে না।, এই বলে নিজের আঙুলের থেকে আংটি খুলে অমিতর আঙুলে আসে- আসে- পরিয়ে দিলে। অমিত তাতে কোন বাধা দিলে না। সায়াহ্নের এই পৃথিবী যেমন অন-রশ্মি উদ্ভাসিত আকাশের দিকে নিঃশব্দে আপন মুখ তুলে ধরেছে, তেমনি নীরবে, তেমনি শান- দীপ্তিতে লাবণ্য আপন আপন মুখ তুলে ধরলে, অমিতর নত মুখের দিকে। সাত দিন যেতেই অমিত ফিরে যোগমায়ার সেই বাসায় গেল। ঘর বন্ধ, ক সবাই চলে গেছে। কোথায় গেছে তার কোনো ঠিকানা রেখে যায় নি। সেই য়ুক্যালিপটাস তলায় অমিত এসে দাড়ালম খানিকক্ষণ ধরে শূণ্যমনে সেইখানে ঘুরে বেড়ালে। পরিচিত মালী এসে সেলাম করে জিজ্ঞাসা করলে, ‘ ঘরে খুলে দেব কি? ভিতরে বসবেন?’ অমিত একটু দ্বিধা করে বললে, ‘ হ্যা।’ ভিতরে গিয়ে লাবণ্যর বসবার ঘরে গেল। চৌকি টেবিল শেলফ আছে, সেই বইগুলি নেই। মেজের উপর দুই একটা ছেঁড়া শুন্য লেফাফা, তার উপরে অজানা হাতের অক্ষরে লাবণ্যের নাম ও ঠিকানা লেখা; দু-চারটে ব্যবহার করা পরিত্যক্ত নিব এবং ক্ষয়প্রাপ্ত একটি অতি ছোটো পেনসিল টেবিলের উপরে। পেনসিলটি পকেটে নিলে। এর পাশেই শোবার ঘর। লোহার ঘাটে কেবল একটা গদি, আর আয়নার টেবিলে একটা শূন্য তেলের শিশি। দুই হাতে মাথা রেখে অমিত সেই গদির উপর শুয়ে পড়ল, লোহার খাটটা শব্দ করে উঠল। সেই ঘরটার মধ্যে বোবা একটা শূন্যতা। তাকে প্রশ্ন করলে কোনো কথাই বলতে পারে না। সে একটা মূর্ছা, যে মুর্ছা কোনোদিনই আর ভাঙবে না। তার পরে শরীরে মনের উপর একটা নিরুদ্যমের বোঝা বহন করে অমিত গেল নিজের কুটিরে যা যেমন রেখে গিয়েছিল তেমনিই সব আছে। এমন কি, যোগমায়া তাঁর কেদারাটিও ফিরিয়ে নিয়ে যান নি। বুঝলে, তিনি স্নেহ করেই এই চৌকিটি তাকে দিয়ে গেছেন; মনে হল যেন শুনতে পেলে শান- মধুর স্বরে তাঁর আহবান-‘বাছা!’ সেই চৌকির সামনে মাথা লুটিয়ে অমিত প্রণাম করলে। সমস- শিলঙ পাহাড়ের শ্রী আজ চলে গেছে। অমিত কোথাও আর সান্ত্বনা পেল না।

লেখক সম্পর্কে জানুন |
সর্বমোট পোস্ট: ০ টি
সর্বমোট মন্তব্য: ১ টি
নিবন্ধন করেছেন: মিনিটে

মন্তব্য করুন

go_top