Today 11 Oct 2025
Top today
Welcome to cholontika

আমি এবং আমার বাবা

: | : ১০/০৬/২০১৩

আমার বাবা ৮/১০টা বাবা থেকে আলাদা। একেবারেই আলাদা। বাবার মতো জনদরদী এমন মানুষ খুজে পাওয়া কষ্ট হবে। জন্মের পড় থেকেই যাকে আপন বলে জানতাম তা হলো মায়ের পরে বাবা। বাবার আদর ভালোবাসায় আজ আমি আজকের অবস্থানে আসতে পারছি। আমি আমার বাবার প্রথম সন্তান। প্রথম সন্তান হিসেবে আমি অন্যান্য ভাই-বোনদের থেকে আলাদা আদর পেতাম। জন্মের এক বছরের মাথায় আমি আমার বাবাকে যখন অধো অধো বুলিতে আব্বা…আব্বা…বলে ডাকতাম তখন থেকে আমি আমার বাবার প্রিয় ছেলে হয়ে গেলাম। বাবা কোথাও গেলে আমি কেঁদে কেঁদে হয়রান হতাম। বাবাকে একনজর দেখার জন্য আমি এদিক ওদিক ছুটাছুটি করতাম। আর মা তখন আমার খুঁজে পেরেশান হয়ে যেত। বাবা বাজারে গেলে তার পিছে পিছে যেতাম। আব্বু… বাজা…ম…জা, আনবেন আধো আধো ভাষায় বলতাম। বাবা আমার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনতেন এবং সত্যি সত্যি বাজার থেকে মজা নিয়ে আসতেন। তারপর ধীরে ধীরে যতই বড় হতে লাগলাম ততই আমি বাবার কাছাকাছি চলে আসলাম। আমার বাবা ছিলেন একজন দরিদ্র কৃষক। অন্যের জমি বর্গা চাষ করে কোন রকম সংসার চালাতেন। আমার বয়স যখন পাঁচ বৎসর তখনই আমার কিছুটা বোধ শক্তি হয়েছে যে, দরিদ্র বাবার কাজে আমাকে সহযোগিতা করা উচিত। বাবা যেখানে যেতেন সেখানেই আমাকে নিয়ে যেতেন। আমিও যাওয়ার জন্য বায়না ধরতাম। মাঝে মাঝে বাবার সাথে কাজে যেতাম। বাবা হাল চাষ করতেন আমি গরুর পিছে পিছে ছুটতাম। বাবা মই দিতেন। আমি মইয়ে উঠতাম। বাবা ক্ষেত নিড়াতেন আমিও বাবার সাথে ক্ষেত নিড়ানোর জন্য বায়না ধরতাম। তখন বাবা আমাকে ছোট একটা নিড়ি কাচি কিনে দিলেন। আমি মাঝে মাঝে বাবার সাথে ক্ষেত নিড়াতাম। আগাছার পরিবর্তে মাঝে মাঝে ভাল গাছও তুলে ফেলতাম। এ নিয়ে বাবা আমাকে মাঝে মাঝে বকা দিতেন। তখন আমি কেঁদে ফেলতাম। অমনি বাবা আমাকে আদর করে শিখিয়ে দিতেন। এভাবে দিনে দিনে বড় হতে লাগলাম। আর বাবার সাথে থেকে থেকে কৃষি কাজ শিখে ফেললাম। আমি একদিন বায়না ধরলাম আমাকে একটি ছাগল কিনে দেয়ার জন্য। বাবা আমার আবদার রক্ষা করলেন। তবে টাকার অভাবে ছাগল কিনে দিতে পারেন নি। ভাগী এনে দিলেন। এতেই আমি খুশী। মাঝে মাঝে বাবা আমাকে স্কুলে যাওয়ার কথা বলতেন। স্কুলের কথা বললেই আমি ছাগল নিয়ে চড়ে চলে যেতাম। আমাদের বাড়ীর পাশেই ছিল বিরাট বড় এক চড়। যেখানে আমার বয়সের অসংখ্য ছেলে-মেয়ে গরু-ছাগল নিয়ে ঘাস খাওয়াতে যেত। আমিও সেখানে চলে যেতাম। ছাগল আলগা ছেড়ে দিয়ে ডাংগুলি, গোল্লাছুট, কানামাছি, বউছি, হাডুডু ইত্যাদি খেলা খেলতাম। এই দেখে আমার মা খুব চিন্তিত ছিলেন। অর্থের অভাবে বাবা ক্লাস নাইন পর্যন্ত লেখাপড়া করেছেন। আর সামনে এগুতে পারেননি। তারপর সংসার জীবন শুরু করে অভাবের সংসারের গ্লানি টেনে যাচ্ছেন। এখন আমিও যদি বাবার মতো কৃষক হয় তাহলে কিভাবে এই দেশ জাতি উন্নতি করবে। সবসময় মা আমার লেখাপড়া নিয়ে চিন্তিত থাকতেন। একদিন আমার পড়াশুনা নিয়ে বাবার সাথে মায়ের ঝগড়া হয়।

মা বলেন, আপনি নিজেও লেখাপড়া করেননি। ছেলেকেও লেখাপড়ার শিখানোর মতো আগ্রহ দেখাননি।

বাবা বলেন, আমিতো তাকে প্রতিদিন স্কুলে যাওয়ার কথা বলি না গেলে কি করব।

তারপর একদিন বাবা আমাকে নিয়ে রাতের বেলা পড়াতে বসলেন। আমি পড়া পারছিলাম না। এইজন্য আমাকে অনেক মাইর দিলেন। সেইদিন থেকে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম আমি লেখাপড়া করব। মানুষের মত মানুষ হব। আমাদের সংসারের স্বচ্ছলতা ফিরিয়ে আনব। তারপর থেকে আমি নিয়মিত স্কুলে যেতে শুরু করলাম। বাবার কাজেও মাঝে মাঝে সহযোগিতা করতে লাগলাম।  প্রতিদিন রাতে মায়ের সাথে বসে পড়তাম। বাবা মাঝে মাঝে আমার পড়া নিতেন। বছরের শুরুতে বাবা আমাকে প্রথম শ্রেণীতে ভর্তি করে দিলেন। মনযোগ দিয়ে পড়া শুনা করার সুবাধে আমি প্রথম স্থান অধিকার করে প্রথম শ্রেণী থেকে দ্বিতীয় শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হয়। তারপর ধারাবাহিকভাবে সেই ক্রমিক নং ক্লাশ টেন পর্যন্ত ধরে রেখেছিলাম। আমার ছোট তিন ভাই ও এক বোন ছিল। তারাও আমার সাথে লেখাপড়ায় যোগ দিল।

বাবা একদিন ভাবলেন এভাবে দিনমজুরী করে সংসার চালিয়ে ছেলে-মেয়েকে লেখাপড়া করানো সম্ভব না। তাই তিনি জমিজমা বিক্রি করে বিদেশ যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। ১৯৯৩ সালের ১০ মে। আমি তখন ক্লাশ থ্রীতে পড়াশুনা করি। আমি বাবাকে এগিয়ে দেওয়ার জন্য ইয়ারপোর্টে গেলাম। সকাল আটটায় বাবার প্লাইট। সাতটা সময় বাবা আমাদের কাজ থেকে বিদায় নিলেন। বিদায় বেলা বাবা আমার গলায় জড়িয়ে কেঁদে কেঁদে বললেন, দোয়া কর বাবা, আমাদের আর অভাব থাকবেনা। ভালকরে লেখাপড়া করিও ছোট ভাই-বোনদেরকে আদর করিও। তার পর বাবা চলেন গেলেন ইয়ারপোর্টের ভিতরে। আমার মন তখন বাবার জন্য কাঁদছিল। বাবা যখন বিমানে উঠে আমি তখন তাকিয়ে দেখছিলাম। বাবা হাত নাড়িয়ে শেষ বিদায় জানিয়ে বিমানের ভেতর চলে গেলেন। এর কিছুক্ষণ পর বিমান আকাশের দিকে উড়তে লাগল। যতক্ষণ খালি চোখে বিমান দেখা গিয়েছিল ততক্ষণ আমি বিমানের দিকে তাকিয়ে ছিলাম।

এখনকার মতো তখন মোবাইল ছিলনা যে ইচ্ছে করলেই বাবার সাথে কথা বলতে পারবো। তখন যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম ছিল চিঠি। বাবার বিদেশ যাওয়ার আঠার দিন পর আমাদের কাছে একটি চিঠি আসে। মায়ের কাছে একটি ও আমার কাছে একটি চিঠি।  আমার কাছে যে চিঠিটি পাঠিয়েছিল সেটি ছিল-

স্নেহের আমির হোসেন

সর্ব প্রথমে আমার সালাম ও দোয়া নিও। আশা করি তোমার শরীর ভাল। তোমার মাকে আমার সালাম দিও। তোমার ভাইবোনদেরকে আমার স্নেহ দিও।

পরসংবাদ এই যে, আমি ১০ আমি ঠিকমত ওমান এসে পৌঁছেছি। চাকরী এখনও পাইনি। দোয়া করিও যাতে সুস্থ্য শরীর নিয়ে কাজ করতে পারি। তোমাদের সুখের জন্য হাজার হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে তোমাদের চোখের আড়ালে চলে আসলাম। আমার জন্য কোন চিন্তা করিও না। ঠিকমত লেখাপড়া করিও। আমার চিঠির উত্তর দিও। এই বলে এখানেই শেষ করলাম।

ইতি তোমার বাবা

বাবা দীর্ঘ আঠার বছর মাথার ঘাম পায়ে ফেলে প্রবাস জীবন কাঠিয়ে এখন তিনি বাড়ীতে। আমি এখন বড় হয়েছি। লেখাপড়া শেষ করেছি। বাবার স্বপ্ন পূরণ করেছি। বাবাকে হজ্জ্ব করিয়ে এনেছি। বাবাকে বলছি বাবা আপনি আর কোন কাজ করবেন না। এখন আপনি নাতী-নাতনীদের নিয়ে বাকী জীবন সুখে শান্তিতে কাটাবেন।

লেখক সম্পর্কে জানুন |
সর্বমোট পোস্ট: ০ টি
সর্বমোট মন্তব্য: ১ টি
নিবন্ধন করেছেন: মিনিটে

মন্তব্য করুন

go_top