উপন্যাস “প্রচ্ছায়া” (৪র্থ পর্ব)
৪
রামপুরা ব্রীজের নিচে থেকে আরেক তরুনীর লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। মেয়ের বাবা শহিদুল্লাহ চৌধুরী মর্গে গিয়ে লাশ সনাক্ত করেছেন। মেয়ের নাম সোমা চৌধুরী। সোমা ঢাকা ইডেন কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্রী। রাজিয়ার মতো সোমারও মুখশ্রী বিগড়ে গেছে। দুইটি হত্যাকান্ডে এক-ই পদ্ধতি অনুসরণ করায়, পুলিশ ধারনা করছে, রাজিয়া ও সোমা হত্যার পেছনে সংঘবদ্ধ কোনো চক্র জড়িত।
শহিদুল্লাহ চৌধুরী মিজানের খালু আর সোমা সম্পর্কে খালা’ত বোন। সোমার মৃত্ত্যুর খবর পেয়েও মিজান লাশ দেখতে বা খালা খালুকে সান্ত্বনা দিতে যায় নি। লাশ দেখলে তার নাকি প্রচন্ড খারাপ লাগে। রাতে ঘুম হয় না। চোখ বুজলেই মৃত মানুষের মুখ তার চোখের সামনে ভেসে ওঠে।
সোমার মৃত্ত্যুর খবর ক্যাম্পাসে পৌছার পর থেকে কলেজে উত্তেজনা বিরাজ করছে। কলেজ এলাকার নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। মেয়েরা মানববন্ধন করছে। এছাড়াও যে পর্যন্ত সোমার হত্যাকারী ধরা না পড়বে, সেই পর্যন্ত ক্লাস বর্জনসহ শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে নানাবিধ কর্মসূচীর ঘোষনা দেওয়া হয়েছে। এই ঘটনায় শিক্ষামন্ত্রী ও স্বররাষ্ট্রমন্ত্রী মহোদয় দুঃখ প্রকাশ করেছেন।
মাস দেড়েকের মধ্যে রাজধানীতে দুই তরুনীর মুখশ্রী বিগড়ে যাওয়া লাশ উদ্ধার ! খবরটি মিডিয়াতে বেশ জোরে সুরেই এসেছে। সব ক’টা টক শো-তে এ নিয়ে তুমুল আলোচনা হচ্ছে। টকশো-র টকারগণ উক্ত ঘটনার রেশ টেনে বলছেন, ইট’স এলার্মিং ফর আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি। আবার কেউ বলছেন, সত্যি এটা ফাটাল। ঘটানায় উদ্বিগ্ন হয়ে কি কথা বলার সময় তারা একই বাক্যে এ রকম একাধিক ভাষার প্রয়োগ করছেন, না এটা তাদের স্টাইল ঠিক বুঝা যাচ্ছে না। না কি আমাদের দেশের শিক্ষিত সমাজের কেউ কেউ উত্তেজিত হলে পরে নিজের মাতৃভাষা ভুলে যান ? আর ভুলে যান বলেই কি তারা নতুন একটি ভাষা তৈরী করেছেন ? যে ভাষায় রয়েছে, অর্ধ ইংলিশ, আর অর্ধ বাংলা। এই ভাষার নাম করণ হয়ে গেছে ? মনে হয়, হয় নি অদৌ।
নাম করণ হউক বা না হউক, এই ভাষা শোনে বাঙালি ও ইংরেজ এই দুই জাতিই যে বিস্মিত হয় বা হবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। বাঙালিদের চেয়ে ইংরেজদের বেশি বিস্মিত হবার কথা, কারণ তারা কিছুতেই ধরতে পারবে না এটা কোন ভাষা। বাঙালিরা মানুষ ছোট হলেও তাদের কলিজা অনেক বড় । তাই তো তারা অত সহজে কোনো কিছুতে বিস্মিত হয় না। বাঙালিদের চোখের সামনে লঞ্চ ডোবে শতাধিক লোক মারা যায় ! আক্ষেপ আফসোসের মেয়াদ এক সপ্তাহের উপরে হয় না ! এক সপ্তাহ পর তারা আবার গাদাগাদি করে একশ জনের লঞ্চে দুইস জন চড়ে। ফের লঞ্চ ডোবে, ফের মানুষ মরে। বাঙালিরা সপ্তাহ খানের ফের আফসোস করে, তারপর সব শেষ। সরকার লোক দেখানো তদন্ত কমিটি করে। সেই কমিটি দ্বায়সারা রিপোর্ট দেয়। ব্যাস, সবার দায়িত্ব শেষ !
বাঙালিদের চোখের সামনে গাড়ীতে আগুন দিয়ে মানুষ পোড়ে মারা হয়, আর বাঙালিরা নিরবে দাড়িয়ে তামাশা দেখে ! এবং যারা জিন্দা মানুষ পুড়িয়ে মারল, জেনে শোনে তাদের পেছনেই মিছিল করে, গলা ফাঁটানো শ্লোগাণ দেয়, অমুক নেতা জিন্দাবান ! নির্বোধের দল একাবারো ভাবে না, আজ আমার প্রতিবেশিকে পুড়িয়ে মেরেছে । আগামীকাল আমাকে যে মারবে না, তার কী গ্যারান্টি ?
সোমার অপমৃত্ত্যুর খবরে মানবাধিকার সংস্থাগুলো সরব হয়ে ওঠেছে । মানব অধিকার পরিস্থিতি নিয়ে তারা আশঙ্কা প্রকাশ করেছে। পত্রিকাগুলোতে সোমার জীবনি ছাপা হচ্ছে রোজ । সোমা কী খেতে ভালোবাসত, তার হবি কী ছিল, কোন রঙ প্রিয় ছিল, এসএসসি-তে কোন গ্রেট পেয়ে ছিল, ফুটবল না ক্রিকেট তার প্রিয় খেলা ছিল, কোন লেখকের বই পড়তে বেশি ভালোবাসত, ইত্যাদি ইত্যাদি। কয়েকদিন বিরতিহীন ভাবে সভা, সিমিনার, গোল টেবিল, লম্বা টেবিলসহ সর্বত্র সোমার মৃত্ত্যু নিয়ে আলোচনা হল। সবার আঙ্গুল আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দিকে হলেও, বিরোধীদলের আঙ্গুল সরাসরি সরকারের দিকে। বিরোধীদল এমন ভাবে সরকারের বিরুদ্ধে রুখে দাড়াতে বলছে, যেন তারা নিজ চোখে দেখেছে যে সরকার-ই রাজিয়া ও সোমাকে হত্যা করেছে !
এত কিছু হবার পরও পুলিশের টনক নড়ে নি। তদন্ত গতি শ্লথ। আমাদের দেশের বড় বড় কর্তা ব্যক্তিগণ বোধ হয় ইচ্ছে করেই নিজেদের কান পরিষ্কার করেন না । কানে কম শোনলে ফয়দা অনেক বেশি, বেহুদা নিরীহ জনগণের চিল্লাচিল্লি শোনতে হয় না। আমাদের দেশে যেমন ঘনঘন ঋতু বদলে, মানুষের দৃষ্টিকোণও তেমনি ঘনঘন বদল হয়। অনেকে দেখেও অনেক কিছু দেখেন না। আবার যারা দেখে তারা যার যার স্থান থেকে চিল্লাচিল্লি করে ক্লান্ত হয়ে এক সময় নিজেরাই থেমে যায়। কাউকে বলতেও হয় না, অনেক হয়েছে, এবার অফ যান। সোমার ক্ষেত্রেও তার ভিন্নটি দেখা গেল না।