উপন্যাস “প্রচ্ছায়া” (৫ম পর্ব)
প্রতিদিন সাড়ে তিনটার দিকে মিজান নাচের স্কুলে হাজির হয়। বসার ঘরে বসে চা খায় আর আধঘন্টা ধরে ম্যাডামের সঙ্গে গল্প করে। তারপর শুরু হয় নাচের ক্লাস। গল্পের অবশিয নির্দিষ্ট কোনো বিষয বস্তু নেই, একেক দিন একেক ব্যাপারে আলোচনা হয, বলা যায় খেজুরে আলাপ।
মিজান দ্বিতীয় দিন-ই বলে ছিল তাকে প্রতিদিন চা দেওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই, তার মুখে চা রুচে কম। কিন্তু ম্যাডাম সেই কথা কানে তুলেন নি। তিনি প্রতিদনই মিজানকে চা দেন, এবং সুবোধ বালকের মতো মিজানকে সেই চা শেষ করতে হয়। চা খেতে খেতে শুরু হয় ম্যাডামের সঙ্গে আলাপচারিতা। এখানে ভর্তি হবার পনেরো দিন যা গল্প হয়ে ছিল তার ধরন ছিল এই রকম। ঐদিন মিজান ঠিক সাড়ে তিনটার দিকে নাচের স্কুলে এসে হাজির হল। ম্যাডান তখন টিউবওয়েলে হাত মুখ ধৌত করতে ছিলেন। মিজান এদিক ওদিক না তাকিয়ে সোজা বসার ঘরে গিয়ে ঢুকল। কিছুক্ষণ পর ম্যাডাম চা নাশতা নিয়ে এলেন। ঘরে ঢুকতে ঢুকতেজিজ্ঞেস করলেন, কেমন আছ মিজান ?
মিজান মৃদু হেসে জবাব দিলো, জ্বী, ভালো।
টেবিলের উপর হাতের ট্রে রেখে ম্যাডাম ফের বললেন, নাচের ক্লাস কেমন লাগছে ?
ভালো।
ম্যাডাম কাপে চা ঢেলে এককাপ মিজানের দিকে এগিয়ে দিয়ে নিজে এককাপ হাতে নিলেন। সেই কাপের অর্ধেক খালি হবার পর মযাডাম ফের বললেন, মিজান।
জ্বী।
তুমি কি প্রেম টেম করো ?
ম্যাডামের এই প্রশ্ন মিজানকে খানিক চমকে দিলো। ম্যাডামের কাছ থেকে সে এই ধরনের প্রশ্ন প্রত্যাশা করে নি। তাই তো অপ্রতিভ স্বরে বলল, না।
আমিও এমনটিই ভেবে ছিলাম। প্রেম করলে প্রতিদিন টাইমলি আসতে পারতে না।
ম্যাডামের প্রশ্ন শোনে মিজান মোটামোটি কুঁকড়ে গেছে । তাই তো কাপ খালি করতে বেশ সময় লেগে গেল। কাপ খালি হবারও ঢের সময় পর মিজান বলল, একটা কথা বলি /
হ্যা বলো। একটা কেন, ইচ্ছে করলে দশটি প্রশ্ন করতে পার। আমার কাছে সংকোচ করার কিছু নেই। আমি টিচার পরে, আগে বন্ধু। ম্যাডামের সরল উক্তি।
ম্যাডেমের এই কথাটি মিজানের কাছে অনেক ভালো লাগল। তার মুখবরের মলিনতা কাটতে শুরু করেছে। সোফায় হেলান দিতে দিতে মিজান বলল, আপনার কি নলিতা ?
হ্যা।
আপনি কি একাই থাকেন ?
এবার ম্যাডামের হাস্যোজ্জ্বল মুখ কালো হতে লাগল। খানিক সময় নিয়ে লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে তিনি বললেন, হ্যা।
মিজান এমনিতে স্বল্পভাষী । বিনা প্রয়োজনে সে কথা বলতে পছন্দ করে না। আজ কেন যেন তাগ ম্যাডামের সম্পর্কে জানতে ইচ্ছে করছে।
আপনার স্বামী কোথায় ?
লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে অনেকটা হতাশার স্বরে ম্যাডাম বললেন, নেই। ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে।
কিন্তু মিজানের সেই দিকে লক্ষ্য নেই বললেই চলে। সে একের পর এক প্রশ্ন করেই যাচ্ছে। মিজান পরক্ষণেই বলল, জানতে পারি কেন ?
সোফায় আড়ষ্ট হতে হতে ম্যাডাম অত্যন্ত শীতল কন্ঠে বললেন, সবাই স্বার্থপর। স্বার্থ ছাড়া কেউ কিছু চিনে না, কেউ কিচ্ছু করতে চায় না। ভালোবাসার কোনো মূল্য নেই, ভালোবাসা বলতে কিছু নেই পৃথিবীতে। ছয় বছর যার সঙ্গে ঘর করলাম, জীবনের চেয়েও যাকে বেশি ভালোবেসে ছিলাম, বাচ্চা দিতে পারি নি বলে সে-ই আমাকে লাথি মেরে তাড়িয়ে দিলো !
ম্যাডামের শ্যামা মুখ অন্ধকার গহ্বরে তলিয়ে গেছে। আঁচল টেনে তিনি দুই চোখ মুছলেন। শান্ত হয়ে মিজানও খানিক বসে রইলো। বেশ কিছুক্ষণ পর মিজান ফের বলল, এখানে আপনি চাকরী করেন ?
বলতে পারো সে রকম-ই।
আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না।
ম্যাডাম বললেন, আমার স্বামী গৌরঙ্গ সাহা ঢাকা শহরের নামকরা চামড়া ব্যবসায়ীদের একজন। আমাদের বিয়ের পরের বছর তিনি এই জমিটা কিনে ছিলেন। জমি কিনার পর আমার নামে রেস্ট্রি করে দিলেন। বিয়ের পর আমিও বসে থকি নি । ছোট বেলা থেকেই নাচ শিখতাম বলে নাচের প্রতি আমার ভীষণ দুর্বলতা ছিল। বিয়ের পর আমি একটি নাচের স্কুলে চাকরী নিই। আমার স্বামী আমার রোজগারকৃত এক পয়সাও খরচ করেন নি। কখনো প্রয়োজনও পড়ে নি অবশ্য, তার নিজেরই টাকার অভাব নেই। আমারটায় হাত দিবেন কেন ? মাস শেষে আমার বেতনের সব টাকা ব্যাংকে জমা রাখতাম। আমাদের যখন ছাড়াছাড়ি হয়ে গেল, আমার স্বামী আমার হাতে একলাখ টাকার একটি চেক দিয়ে বললেন, বাইপালের জমিটা আর এই সামান্য তোমাকে দিলাম। আশা করি তুমি আমাকে ক্ষমা করে দিবে। শালার টাকাই সব।
ম্যাডামের চোখ ফের জলে ভরে গেছে। তিনি আর চোখ মুছলেন না । কিছুক্ষণ চুপ থেকে ফের বললেন, তারও কোনো উপায় ছিল না। বংশ রক্ষার প্রয়োজনটাও তো কম নয়। আমি তো পারছিলমা না সেই প্রয়োজন মিটাতে। সেই জন্যে তাকেও দোষ দেই না। সবি আমার কপালের দোষ। আমি ঐ বাড়ি ছেড়ে চলে এলাম। ভাইয়ের ওখানে অলস বসে থাকতে মোটেও ভালো লাগছিল না। সময় যেন স্থির হয়ে এল। তারপর অনেক ভেবে চিন্তে এই স্কুলটা দাড় করিয়েছি।
মিজান বলল, একা থাকতে ভয় লাগে না ?
ম্যাডাম তার চোখ মুছতে মুছতে মুচকি হেসে বললেন, ভয় লাগবে কেন ? আমি কারো ক্ষতি করি নি। আমারও কেউ ক্ষতি করবে না। তাছাড়া আমার ছোট ভাই থাকে আমার সাথে।
তাকে তো একদিনও দেখলাম না।
সে ধামরাইয়ে ব্যবসা করে। রাতে আসে আর ভোরেই চলে যায়।
বেশ কিছুক্ষণ পর চায়ের ট্রে হাতে নিয়ে ওঠতে ওঠতে ম্যাডাম বললেন, এখন থেকে তোমাকে আর একঘন্টা আগে আসতে হবে না। তোমার আগ্রহ প্রবল, চেষ্টাও ভালো। অল্প দিনে ভালো শিখেছ। এরপর থেকে সবার সাথে ক্লাস করেলই চলবে।
ম্যাডামের কথামতো মিজান তারপর থেকে সবার সঙ্গেই ক্লাস করতে শুরু করল। এখন তার দুটো কাজ। দিনে নাচ শেখা, আর নিশিতে খালি রাস্তায় গাড়ী হাকিয়ে বেড়ানো।