Today 11 Oct 2025
Top today
Welcome to cholontika

ফটো

: | : ০৫/১০/২০১৩

এক যুবক দাঁড়িয়ে আছে। তার পরনে হাফ শার্ট আর প্যান্ট। তার সামনে শাড়ি পরে লতানো শরীরের এক মেয়ে দাঁড়িয়ে। মেয়েটা লজ্জিত ও ভীরু দৃষ্টিতে ছেলেটার চোখের দিকে তাকিয়ে তার গলায় স্টেথোস্কোপ ঝুলিয়ে দিচ্ছে। ছেলেটা মেয়েটার মুখের দিকে আনাড়ি চোখে তাকিয়ে আছে। দুজনের এক পার্শ্ব দেখা যাচ্ছে। এটা একটা ফটো। ফটোটা আজ থেকে ত্রিশ বছর আগে তোলা। ছেলেটার নাম রুমেল আর মেয়েটার নাম বেলা।

রুমেল যখন রাজশাহী মেডিকেল কলেজে ফার্স্ট ইয়ারে আর বেলা ইন্টারমিডিয়েটে পড়ে তখন তারা নাটোর শহরের একটা স্টুডিওতে ছবিটা তুলেছিল।

বেলাদের বাড়ি সিরাজগঞ্জ শহরে আর রুমেলদের বাড়ি সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ায়। বেলার বাবা যখন রুমেলদের থানায় নির্বাহী প্রকৌশলী হিসাবে কর্মরত থাকার সুবাদে সেখানেই পরিবার নিয়ে থাকতেন তখন বেলাদের পরিবার আর রুমেলদের পরিবারের মধ্যে পারিবারিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। সে সময় বেলা এসএসসি পাশ করেনি আর রুমেল কলেজে পড়ে। বেলারা দুই বোন তিন ভাই। বেলাই সকলের বড়।

সম্পর্কটাকে স্থায়ী করার জন্য বেলার বাবা এবং রুমেলের বাবার মধ্যে কথা হয় যে রুমেলের পড়া শেষ হলে রুমেল আর বেলার বিয়ে দেবেন। এ কথাটা দুই পরিবারের সকলেই জানতো। আর তারই পথ ধরে রুমেল আর বেলার মধ্যে প্রণয় গড়ে ওঠে।

রুমেল ইন্টারমিডিয়েট পাশ করে রাজশাহী মেডিকেল কলেজে ভর্তি হয়। আর বেলার বাবা উল্লাপাড়া থানা থেকে বদলী হয়ে নাটোর চলে যান। বেলা ওখানকার কলেজে ভর্তি হয়।

রুমেলের বাবা স্ত্রীকে এবং শিশু ছেলেকে নিয়ে মাঝে মাঝে নাটোর বেলাদের বাসায় বেড়াতে যেতেন। সকলেই তাদেরকে পেয়ে আনন্দে মেতে উঠতো।

রুমেলের বাবা ছোট্ট ছেলেটাকে নিয়ে ফজরের নামাজ পড়েই ভোরের নির্মল হাওয়ায় নাটোর শহরে হাঁটতে বের হতেন। তখন বাসার জায়গীর এক ছেলে সুন্দর কন্ঠে কোরআন তেলাওয়াৎ করতে বসতো। বেলার বাবা বাসা থেকে বের হওয়ার পর যতই এগিয়ে যেতেন কোরআন তেলাওয়াৎ এর মধুর ধ্বনি তার কানে ততই ক্ষীণ হয়ে যেত।

রুমেলের বাবা বাসায় ফিরে এলে বেলা নাস্তা খাওয়াতে ব্যস্ত হয়ে যেত। বিকালে সবাই একসঙ্গে বেড়াতে বের হতো। বাবা-মার কথা ভুলে গিয়ে রুমেলের বাবা-মাকে বেলার অধিক যত্ন করা দেখে বেলাদের বাসার সবাই মাঝে মাঝে মুখ টিপে হাসতো। বেলা তা দেখে ক্ষেপে যেত।

রুমেলের বাবা মা যে কয়েকদিন থাকতেন সে কয়েকদিন বেলা ঘুমানোর সময়টা ছাড়া বাকি পুরোটা সময় তাদের প্রতি তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখতো। খাওয়া, গোসল, ওজুর পানি এগিয়ে দেওয়া, নামাজের জায়নামাজ এগিয়ে দেওয়া, ঘুমের ব্যবস্থা করা সহ সবকিছু। আর রুমেলের ছোট ভাইটাকে সে সবসময় কাছে করে রাখতো, তার কাছে নিয়ে ঘুমাতো।

বাবার কাছ থেকে টাকা নিয়ে বেলা নিজে পছন্দ করে মার্কেট থেকে গিফট কিনে আনতো। তার ভিতর একটা চিন্তা কাজ করতো যে তার কোন কাজে সামান্য খুঁত থাকলেই সে বুঝি রুমেলদের বাড়ির বউ হতে পারবে না।

রুমেলের বাবা, মা যখন বিদায় নিতেন তখন এক করুণ পরিবেশের সৃষ্টি হতো। বেলা গিয়ে রুমেলের বাবা মা-কে সালাম করতো। তারা বেলার মাথায় হাত বুলিয়ে বলতেন, থাক মা থাক, বেঁচে থাকো।
ছল ছল চোখে বেলা জিজ্ঞেস করতো, আবার কবে আসবেন?
তারা বলতেন, তারাতারিই আসার চেষ্টা করবো।
তারা চলে যাওয়ার পর বেলা সারাদিন নিরবে শুয়ে থাকতো।

বেলার সমবয়সী রুমেলের এক বোন আছে। সেও যেত বেলাদের বাসায়। রুমেল রাজশাহী থেকে নাটোর বেড়াতে আসতো মাঝে মাঝে।

রুমেল যখন থার্ড ইয়ারে পড়ে তখন রুমেলদের থানার দিনা নামের এক মেয়ে রাজশাহী মেডিকেল কলেজে ভর্তি হয়। সিনিয়র স্টুডেন্টদের কাছে জুনিয়র স্টুডেন্টরা পড়াশোনার ব্যাপারে সাহায্য নেয়। উপরন্তু দিনাদের বাড়ি রুমেলদের থানায়ই। সে হিসাবে ঘন ঘন তাদের দেখা সাক্ষাৎ হতো।

বেলা ইন্টারমিডিয়েট পাশ করে নাটোরেই ডিগ্রীতে ভর্তি হয়।

সে সময় রুমেল ছিল রাজশাহী আর বেলা ছিল নাটোর। কদাচিৎ তাদের দেখা হতো। আর দিনা ছিল রাজশাহী।

দিনার সাথে সবসময় দেখা হতো বলে তার প্রতি একটু একটু করে রুমেলের মনে অন্যরকম আকর্ষণের জন্ম হয়। তাছাড়া দিনা ডাক্তার হলে ভবিষ্যৎ জীবন গড়া সহজ হবে মনে করে রুমেল নাটোর যাওয়া বন্ধ করে দেয়।

রুমেল এমবিবিএস পাশ করে নাটোরেই প্রথম জয়েন করে। তখন বেলারা ঢাকায় চলে গেছে।

রুমেল দিনাকে বিয়ে করতে চায়। কিন্তু রুমেলের বাবা রাজী হয় না।
রুমেল তখন বাবার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে নাটোরে তার বোনের বাসায় দিনাকে বিয়ে করে এবং এক বাসাতেই থাকে।

রুমেলের বিয়ের পর বেলা একদম চুপচাপ হয়ে যায়। সাদা কাপড় পরিধান করা শুরু করে। বেলাদের এবং রুমেলদের পরিবারের লোকদের আসা যাওয়াও বন্ধ হয়ে যায়।

একদিন বেলা নাটোর আসে। হাসপাতালে ডিউটিরত অবস্থায় রুমেলকে দেখে সে যায় রুমেলের বোন হিনার বাসায়।

বেলা রুমেলের বোনকে বলে, নাটোর এসেছি দুটো উদ্দেশ্যে। প্রথমটা হলো রুমেল ভাইকে দেখা। তাকে দেখেছি।

কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর সে চোখ মুছতে মুছতে বলে, আর বাসায় এসেছি তার সংসারটা দেখতে।

বেলার কথা শুনে হিনার চোখেও পানি এসে যায়। কেউ কোন কথা খুঁজে পায় না। অঝোরে দুজনের চোখ থেকে শুধু চোখের পানি বের হতে থাকে।

একসময় বেলা হিনার কাছ থেকে বিদায় নেয়।

এরপর বহুদিন কেটে গেছে। রুমেলের ছেলে-মেয়ের বিয়ের সময় হয়ে গেছে। রুমেল তার বাবার ভালোবাসা আর কোনোদিন পায়নি। বর্তমানে রুমেল একটা ছিনতাইয়ের ঘটনায় অভিযুক্ত হয়ে সাময়িকভাবে বরখাস্ত অবস্থায় আছে।

আর বেলা যেদিন হিনার কাছ থেকে কাঁদতে কাঁদতে বিদায় নিয়েছিল সেদিনের পর তাকে বহু চেষ্টা করেও আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। কেউ বলে সে আত্মহত্যা করেছে, কেউ বলে দুর্ঘটনায় মারা গেছে।

লেখক সম্পর্কে জানুন |
সর্বমোট পোস্ট: ০ টি
সর্বমোট মন্তব্য: ১ টি
নিবন্ধন করেছেন: মিনিটে

মন্তব্য করুন

go_top