Today 10 Oct 2025
Top today
Welcome to cholontika

উটন দাদুর কাহিনী–৫ (শিশু ও কিশোরদের বনজঙ্গলের রোমাঞ্চকর উপন্যাস)

: | : ০৭/১০/২০১৩

কিন্তু কাসনি গ্রামে যাবে কি ভাবে! সে অভিযান যে বড় কঠিন। মৃত্যু সেখানে শিয়রের পাশে ঘোরে। সেখানে গেলে আর কি উটন ফিরে আসতে পারবে এই তিন্তারি গ্রামে? না হোক ফেরা, তবু অভিযানের নেশা বড় নেশা–সে জীবনের অনেকখানি সময় তো মৃত্যুর পাশাপাশি চলে দেখেছে। নিজের জন্যে তার আর কি ভাবনা–তার মত একা লোকের থাকা না থাকায় বিশেষ কি এসে যায়! তিন কুলে তো তার কেউ নেই তা হলে এ জীবনের মায়া রেখে কি লাভ?

এ অভিযান তো শুধু মাত্র অভিযান নয়–অভিযানের সঙ্গে সঙ্গে আরও একটা কাজ তাকে করতে হবে যদি ওই জংলী মানুষগুলোকে সভ্যতার সামান্য আলোও দেখানো যায়–ওদের সভ্যতার আলোকে যদি দেখানো যায় ওরা কত অপরাধ করছে–মানুষ হয়ে মানুষের মাংস খাচ্ছে ! স্নেহ,প্রেম,ভালবাসার মানুষ,গুরুজন,পিতা-মাতাকে হত্যা করছে। শুধু তাই নয়,ক্ষুধার তাড়নায় পিতা-মাতাকে হত্যা তো করছেই আবার  তাদের মাংসও খাচ্ছে! হায় রে অমানুষ– মানুষের চেহারায় জন্ম নিয়ে ওরা কি করে পশুর মত কাজ করতে পারে? উটনের মনে প্রশ্ন আসে,আচ্ছা পশুরা কি নিজের মাংস খায়? এমনটা শোনেনি সে–তবু পশুদের পক্ষে তা সম্ভব হলেও হতে পারে কিন্তু মানুষের পক্ষে? মানুষ কি ভাবে পশু হতে পারে!

হোক জীবন সংশয়–না হয় তিন্তারি  গ্রামের আরও কজনের জীবনাবসান ঘটবে। তবু যদি অমানুষ মানুষেরা একটু শিক্ষা পায়! ওরা সভ্য মানুষের জীবন ধারণ করতে পারে–ওরা নিজেদের মাংস খাওয়া বন্ধ করে–বোঝে বৃদ্ধ মাতা,পিতার স্নেহ,মমতা,ভালবাসা ! তবে মৃত্যুতেও উটনের  মনে সান্ত্বনা থাকবে।

ছেলের দল উটনের কাছে অনেক গল্প শুনেছে–উটনের চরিত্রের প্রভাব অনেকটাই তাদের মধ্যে বর্তেছে। ওর সঙ্গে ছোটখাট অনেক রোমাঞ্চকর যাত্রায়  ওরা ভাগ নিয়েছে। ছেলেরা সত্যি সাহসী,ওদের ভাবনা,ওদের সভ্যতার জাগরণের সচেতনতা আর দশটা গ্রামবাসীদের থেকে ছিল অনেক অনেক বেশী। গ্রামের কিশোর ছেলে–নবু,কুন্তা,নেচু,বনুই,শমী এমনি সাতজনকে ডেকে উটন কাসনি গ্রামের গল্প,সেখানকার নরবলীর কথা,সেখানকার নির্দয়তার কথা শুনিয়েছে।

একদিন উটন দাদু তাদের জানালো যে সে অভিযানে যাবে–জীবনের শেষ অভিযানে–সেই জংলী  গ্রামে–কাসনি গ্রামে। নবু, কুন্তা,নেচু, বনুই,শমী সবাই এক সাথে উঠে দাঁড়ালো,ওরা সমস্বরে বলে উঠলো,আমরাও তোমার সাথে যাবো উটন দাদু!

মনে মনে এটাই চাইছিল উটন। তবু বলল,না রে তোদের আমি নিয়ে যেতে পারি না–তোদের জীবনের মূল্য আমার কাছে অনেক বেশী।

কেউ শুনল না উটন দাদুর কথা,ওরা আবার চীৎকার করে উঠলো,আমরাও যাব–আমরাও তোমার সাথে যাব। ওরা যাবে–অভিযানে যাবে–ভয়ের অভিযানে–সংশয়ের অভিযানে।

উটন গোপনে বড় একটা নৌকো তৈরি করাল। যাত্রার দিন-ক্ষণ ঠিক হল। আর একদিন গভীর রাতে সাত সঙ্গীকে নিয়ে অভিযানে পাড়ি দিল উটন দাদু।

সে ছিল এক গভীর রাত। সবাই চুপি চুপি হাজির হল নদীর পারে। সবার সঙ্গে থাকলো–খাবার, বস্ত্র,আত্মরক্ষার লাঠি,চাকু,ছুরি,এ ছাড়া রাখা হয়েছে বড় বড় বল্লম। উটন দাদু তার সব অভিযানের সঙ্গী পাঁচ ব্যাটারির টর্চ আর গাদা বন্দুক সাথে রেখে নিয়েছে।

বড় নৌকো–ভিন গ্রামের লোক নিয়ে তৈরি করানো হয়েছে। উটন নিজে দাঁড়িয়ে এটা তৈরি করিয়েছে। অন্তত বিশ জন লোক অনায়াসে এতে চড়ে যেতে পারে। নৌকো চালাবার লগি,দাঁড়, বৈঠা এ সব আগেই রাখা ছিল নৌকাতে। নৌকো নদী পারের ঘন জঙ্গলের এক কিনারায় বাঁধা ছিল। এ অভিযানের কথা আর কেউ জানবে না।

গ্রামের লোকদের চোখে পড়েছে নৌকো–তারা জানে,উটন পাগলের নৌকো এটা–হবে তার কোন পাগলা মনের পাগলামি কোন ফন্দি। ছেলেদের নিয়ে হয় তো এবার যাবে দূরের কোন জঙ্গলে শিকার করতে নয়তো বন ভাত খেতে–কতবারই তো এমনটা ওরা দেখেছে। এ ব্যাপারে কারো কথা আজ পর্যন্ত কখনও কি শুনেছে উটন বাওড়া ! তাই গ্রামের কারো এতে কোন মাথা ব্যথাই ছিল না।

গডের নাম নিয়ে নৌকো ছাড়া হল। গভীর নদী,দু পারে ঘন জঙ্গল,জঙ্গলে হিংস্র জন্তুজানোয়ারের  বাস। জলে নরভূক কুমিরের দল। এ ছাড়া আছে জলে,স্থলে বিষধর সাপের দল। তবু অসীম সাহস বুকে বেঁধে চলেছে যোদ্ধারা–নতুন অভিযানে। আনন্দ,স্ফূর্তি, ভয়, রোমাঞ্চ নিয়ে স্রোতের দিকে নাও ভাসিয়ে দিয়েছে ওরা !

ছেলেরা আর উটন সময়ে সময়ে নিজেদের মত দাঁড়,বৈঠা চালিয়ে যাচ্ছে—স্রোতের অনুকূলে চলেছে নৌকো।তাই নৌকো চালাতে কিছু মাত্র বেগ পেতে হচ্ছিল না ওদের।     

নৌকায় একটা মাত্র লন্ঠন টিমটিম করে জ্বলছে। আকাশের এক কোণে কাটা চাঁদ দেখা যাচ্ছে —বনের বড় বড় গাছগুলির ফাঁক দিয়ে ভয়াল আন্ধকার চিরে উঁকি দিয়ে আছে। জলে ফালি চাঁদের ম্লান আলো পড়েছে। চঞ্চল ছলছল,উড়ালী নদীর খরস্রোত এগিয়ে চলেছে সামনে–নৌকো এপাশ ও পাশ দুলে দুলে স্রোতের ইশারায় যেন ছুটে চলেছে কোন অজানা রহস্যময় স্থানের দিকে।

বনুই নীরবতা ভঙ্গ করে বলে ওঠে,উটন দাদু,তুমি সেই গ্রাম চিনবে কি করে?

–কোন গ্রাম? অন্যমনস্ক উটন বলে উঠলো,তারপরই মনে হতে,ও কাসনি গ্রামের কথা বলছিস তো ?

মাথা নাড়ল বনুই।

নীরবতা ভঙ্গ করে উটন বলল,আমি লিখে এনেছি–ঠিক যেমনটি দুগ্গু কাকা আমায় বলেছে–ঠিক তেমন করে নক্সা বানিয়েও নিয়ে  এসেছি।

উটন দাদুর কথা শুনে সবাই অবাক হল,নবু  বলে উঠলো,আমরা কখন পৌঁছাব কাসনি গাঁয়ে?

–কাল রাতে। যখন কাসনি গ্রামের সবাই ঘুমাবে তখন চুপি সারে আমরা গিয়ে ঢুকব কাসনি  গ্রামে।

কিন্তু ওরা তো আমাদের ধরতে পারলে কেটে ফেলবে,ভয়ে ভয়ে বনুই বলে ওঠে।

–যা করতে হবে আমাদের তা লুকিয়ে লুকিয়ে করতে হবে,উটন বলে উঠলো।

নেচু সবার ছোট,তবু অভিযানে যাবার উত্সাহ তার ভরপুর। ও কথা খুব কম বলে,ওরা কোথায় যাচ্ছে,কেন যাচ্ছে,এসব  কিছু জানার যেন তার  কিছু আগ্রহ নেই,সবাই যাচ্ছে,এক সঙ্গে যাওয়াটাই ওর কাছে সবচে বড় কথা। ও ঝিমোতে ঝিমোতে বলে উঠলো,উটন দাদু,আমরা কেন যাচ্ছি কাসনি গাঁয়ে?

–আরে এখনও জানিস না তুই! আমরা ওদের দু একজনকে ধরে আনব আমাদের গ্রামে। তারপর ওদেরকে শিক্ষা দেব,কুন্তা বিজ্ঞের মত বলে উঠল।  

–শিক্ষা,ওদের আবার কি শিক্ষা দেব? এবার বনুই প্রশ্ন করল।

উটন দাদু বলে,সব তোদের বলেছি,আমার কথা তোরা মন দিয়ে শুনবি না,ওদের শিক্ষা দিতে হবে মানুষ হয়ে মানুষকে মেরে ফেলা কখনো উচিত না–মানুষ মানুষকে খেলে তাকে দানব, রাক্ষস বলে,জানোয়ার বলে,মানুষ কখনও বলে না।

শমী অনেকক্ষণ ধরে সবার কথা চুপচাপ করে শুনছিল,এবার সে বলে উঠলো,ওরা ওদের নিজের মা,বাবাকেও নাকি কেটে খেয়ে ফেলে!

উটন আগের কথার রেশ নিয়ে বলতে থাকে–ওরা নিষ্ঠুর। ওরা জ্ঞানহীন। ওদের মধ্যে শিক্ষা নেই,ধর্ম ওরা বোঝে না। ওরা এখনও ওদের পূর্বপুরুষদের মত জংলী,নর খাদক। ওরা এখন বলতে গেলে ওদের পূর্ব পুরুষের যুগেই পড়ে আছে–একটুও বদলায় নি। এখনও ওরা উলঙ্গ থাকে। তোরা তবু লেংটি পরিস। তোদের শরীরে পোশাক থাকে।ওদের দেহে কিছুটি থাকে না। তোরা যেমন পুড়িয়ে খাস আবার রান্না করেও খাস ওরা নাকি প্রায় জিনিস কাঁচা খায়–কখনো কখনো মাংস আগুনে ঝলসিয়ে নেয়। আদিম যুগের মানুষ হয়েই রয়ে গেছে ওরা। পাথর ঘষে আগুনটুকু জ্বালাতে নাকি শিখেছে।

–ওদের ঘর আছে ? বনুই প্রশ্ন করে ছিল।

উটন বলতে লাগল–হ্যাঁ,মাটি খুড়ে গর্ত করে তার ওপরে নাকি পাথরের টুকরো বসিয়ে ঘর তৈরি করে। ওই গুহা মানবদের মত আর কি! ওদের ভাষা নেই–নিজেদের বানানো কিছু শব্দ সঙ্কেত আছে তা দিয়েই ওরা পরস্পর পরস্পরের কথাবার্তা আদান প্রদান করে।

সে গ্রাম তো তা হলে ভয়ঙ্কর! বনুই রোমাঞ্চিত হয়ে বলে ওঠে।

এভাবে প্রশ্নোত্তরে রাত অনেক দূর গড়িয়ে গেল। এক সময় সবাই ঘুমিয়ে গেল। উটন দাদুও চোখ বুজে ঝিমাচ্ছিল। ওপর থেকে তাকে দেখলে বোঝা যায় না,সত্যি সে ঘুমিয়ে গেছে না জেগে আছে। 

                                                                               ক্রমশ…

লেখক সম্পর্কে জানুন |
সর্বমোট পোস্ট: ০ টি
সর্বমোট মন্তব্য: ১ টি
নিবন্ধন করেছেন: মিনিটে

মন্তব্য করুন

go_top